পাঁচ শতাব্দী পর নতুন এক ইতিহাস গড়লেন ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও পোপ লিও। বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) ভ্যাটিকানের ঐতিহাসিক সিস্টিন চ্যাপেলে তারা একসঙ্গে প্রার্থনা করেন। ১৫৩৪ সালে রাজা হেনরি অষ্টম রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে ইংল্যান্ডের বিচ্ছেদ ঘটানোর পর এই প্রথম কোনো ব্রিটিশ রাজা ও পোপ একসঙ্গে প্রার্থনায় অংশ নিলেন।
মাইকেল এঞ্জেলোর বিখ্যাত ‘লাস্ট জাজমেন্ট’ চিত্রে ঘেরা চ্যাপেলে সেই প্রার্থনা অনুষ্ঠানে ভেসে আসে লাতিন স্তবগান ও ইংরেজি প্রার্থনার সুর। ছয় মাস আগে এখানেই বিশ্বের কার্ডিনালরা মার্কিন নাগরিক লিওকে ইতিহাসের প্রথম মার্কিন পোপ হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন।
চার্চ অব ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রধান হিসেবে রাজা চার্লস বসেছিলেন পোপের বাঁ পাশে— বেদির কাছাকাছি। অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দেন পোপ লিও ও অ্যাংলিকান আর্চবিশপ স্টিফেন কট্রেল। প্রার্থনায় অংশ নেয় সিস্টিন চ্যাপেল ও দুটি রাজকীয় কয়ার।
যদিও রাজা চার্লস এর আগে টানা তিনজন পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তবে এবারই প্রথম পোপের সাথে যৌথ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হলো।
ভ্যাটিকান সফরে রয়েছেন রাজা চার্লস ও রানি ক্যামিলা। এটি দুই চার্চের সম্পর্কের নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের ধর্মতত্ত্ববিদ রেভারেন্ড জেমস হকি বলেন, ‘এই মুহূর্তটি ইতিহাসের ক্ষত নিরাময় করেছে। এক প্রজন্ম আগেও এটি অকল্পনীয় ছিল। এখন আমাদের দুই চার্চ ৬০ বছরের সংলাপের ফলাফল ভোগ করছে।’
অ্যাংলিকান আর্চবিশপ অব ইয়র্ক স্টিফেন কট্রেল অনুষ্ঠানে সারাহ মুলালির স্থলাভিষিক্ত হন। মুলালি সম্প্রতি ইতিহাসের প্রথম নারী আর্চবিশপ অব ক্যানটারবুরি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। তবে তিনি আগামী বছর দায়িত্ব নেবেন।
রাজা হেনরি অষ্টমের সময় থেকে শত্রুতা ১৫৩৪ সালে ক্যাথলিক চার্চ ও ইংল্যান্ডের চার্চের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাজন ঘটে। ওই সময় পোপ ক্লেমেন্ট সপ্তম রাজা হেনরি অষ্টমের স্ত্রী ক্যাথরিন অব অ্যারাগনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
রাজা হেনরি অষ্টমের মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন পুরুষ উত্তরাধিকারী পাওয়া এবং নতুন বিবাহের মাধ্যমে সেই আশা পূরণ করা। তবে কেবল এ কারণেই নয়— এর পেছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণও কাজ করেছিল।
ইংরেজ রাজতন্ত্র তখন চার্চের বিপুল সম্পত্তি ও ক্ষমতার ওপর দখল নিতে চাইছিল। একই সঙ্গে দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের উত্থানও দ্রুত ঘটছিল, যা রাজাকে রোমান চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
হেনরি অষ্টমের মৃত্যুর পর তার দুই কন্যা — মেরি প্রথম ও এলিজাবেথ প্রথমের শাসনামলে ইংল্যান্ডে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীদের মধ্যে বিবাদ চরমে উঠে। এই সময়ে শত শত মানুষকে কেবল তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অনেককেই জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, যা সেই সময়ের ইংল্যান্ডে ভয়ংকর ধর্মীয় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে।
সেখানে পোপ লিও রাজাকে ‘রয়্যাল কনফ্রাটার’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পাশাপাশি রাজাকে ব্যাসিলিকায় একটি বিশেষ আসন দেওয়া হয়। যা ভবিষ্যতে কেবল ব্রিটিশ রাজাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এই কাঠের আসনে রাজকীয় প্রতীকসহ লাতিন বাণী ‘Ut unum sint’ অর্থাৎ ‘যেন তারা এক হয়’ খোদাই করা আছে।
অ্যাংলিকান প্রতিনিধি বিশপ অ্যান্থনি বল বলেন, ‘এই সম্মান দুই চার্চের যৌথ ভবিষ্যৎ গঠনের প্রতীক।’
বাকিংহাম প্যালেস জানিয়েছে, রাজা চার্লসও পোপ লিওকে দু’টি ব্রিটিশ সম্মান দিয়েছেন— একটি হলো উইন্ডসর ক্যাসেলের সেন্ট জর্জেস চ্যাপেলের প্যাপাল কনফ্রাটার; অপরটি হলো অর্ডার অব দ্য বাথের নাইট গ্র্যান্ড ক্রস।
অ্যাংলিকান-ক্যাথলিক সম্পর্কের নব অধ্যায় ১৯৬০-এর দশকে বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৬৫টি দেশে ৪৬টি চার্চ নিয়ে গঠিত অ্যাংলিকান কমিউনিয়ন ও ১৪০ কোটি সদস্যের ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে সম্পর্ক উন্নতি শুরু হয়।
যদিও দুই সম্প্রদায়ের শিক্ষায় অনেক মিল রয়েছে, তবু ক্যাথলিক চার্চে নারীদের পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় না এবং পুরোহিতদের সাধারণত বিয়ের অনুমতিও নেই।
মন্তব্য করুন