

কুয়াশায় ঢেকে থাকা শীতের রাত। আর সেই রাতেই রাজশাহীর তানোরের কয়েলের হাট মধ্যপাড়ায় এলাকায় শিশু সাজিদকে একনজর দেখতে রাতভর মা রুনা বেগমের দীর্ঘ অপেক্ষা।
দুই বছরের ছোট্ট শিশু সাজিদ। বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুর একটার দিকে মায়ের পেছন পেছন হাঁটতেই ছোট্ট শিশু সাজিদ হঠাৎ পড়ে গেল পরিত্যক্ত একটি টিউবওয়েলের ৪০ ফুট গর্তে।
এরপর বিকেল, তারপর সন্ধ্যা। পরে রাত পেরিয়ে সকাল। এরপরেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি শিশুর ছোট্ট ছোট্ট সাজিদকে। অন্ধকার, ঠান্ডা আর শ্বাসরুদ্ধকর সেই গর্তে আটকে রইল কোমল প্রাণটি।
ঘটনার পরই ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিসের একের পর এক ইউনিট। তিনটি ভেকু মেশিন। পাঁচটি উদ্ধার ইউনিট। মানুষের ঢল। টানটান উত্তেজনা। রাতভর হিমশীতল বাতাসে থমকে থাকা অপেক্ষা।
রাজশাহীর তানোরে দুই বছরের শিশু সাজিদ পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের গর্তে পড়ে যাওয়ার ১৯ ঘণ্টায়ও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে শিশুটি যে গর্তের মধ্যে পড়ে যায় সেদিকে সুরঙ্গ খোঁড়া শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। তবে এখনো সাজিদের দেখা মেলেনি।
ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতার প্রাথমিক ধাপ পেরিয়ে এক্সকাভেটর দিয়ে মাটি সরানো ছাড়া শিশু সাজিদকে উদ্ধার সম্ভব হচ্ছিল না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ছোট্ট সাজিদকে উদ্ধারে এক্সকাভেটরের খোঁজ করা হচ্ছিল। কিন্তু উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এক্সকাভেটর পাওয়া যাচ্ছিল না। এমনকি পুরো তানোর উপজেলায় খোঁজ করেও কোন এক্সকাভেটর পাওয়া যায়নি। অবশেষে রাত ৮টার দিকে পাশের উপজেলা মোহনপুর থেকে ছোট্ট দুটি এক্সকাভেটর এনে মাটি খনন কাজ শুরু করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার ভোর ৬টায় ৪০ ফুট গর্ত করা শেষ হয়। এরপর সেই গর্ত থেকে শিশুটি যে গর্তের মধ্যে পড়ে যায় সেদিকে সুরঙ্গ খোঁড়া শুরু করে। প্রায় দেড় ঘণ্টা থেকে সেই সুরঙ্গ খোঁড়া চলছে তবে এখন পর্যন্ত শিশুটির দেখা মেলেনি।
সবসময় সবার সামনে বসে ছিলেন একজন মা রুনা বেগম। কাঁপা হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন ওঠানামা করা আশা-নিরাশার স্রোত। চোখে নিদ্রাহীনতা, মুখে অসহায়তা, আর বুক ভরা আতঙ্ক।
ছেলের জন্য রাতভর অপেক্ষার পর রুনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর ছিল। দাদার সঙ্গে হাটখোলায় যেতে চেয়েছিল। কিন্তু জ্বর থাকায় দাদা নিয়ে যায়নি। সকালে আমি ওষুধ এনে তাকে খাইয়ে দিয়েছি। কে জানত এমন সর্বনাশ অপেক্ষা করছে! আমার অসুস্থ ছেলেটা এখন ৪০ ফুট মাটির নিচে… এই তীব্র শীতে…।’
এতটুকু বলেই কাঁপতে কাঁপতে বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন তিনি। প্রতিবার জ্ঞান ফিরেই আবার তাকাচ্ছিলেন সেই গর্তের দিকে—চোখে একমাত্র প্রশ্ন, ‘আমার ছেলেটাকে কি আমি আবার জড়িয়ে ধরতে পারব?’
মায়ের অপেক্ষা, সন্তানের বাঁচার সংগ্রাম, আর মানুষের দোয়া—সব মিলেই রাতটি হয়ে ওঠে এক দীর্ঘ, নিঃশ্বাস বন্ধ করা প্রতীক্ষার রাত।
মন্তব্য করুন