ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নানা ধরনের অনিয়মে এমনিতেই গ্রাহকের আস্থাহীনতা বাড়ছে। যার ফলে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। বিপরীতে মানুষের হাতে টাকা রাখার পরিমাণও বাড়ছে। তার ওপর গত জুলাইয়ে সারা দেশে চলমান অস্থিরতায় এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ সময় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। একই সময়ে মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই মাসে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৬ লাখ ৬ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানত বেড়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। কয়েক মাস আগেও আমানতের এই প্রবৃদ্ধি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। এ ছাড়া আগের মাসের তুলনায় আমানত কমেছে ৮ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, জুলাই মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৫ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
আমানত প্রবাহ কমে যাওয়ায় তারল্য সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। ফলে ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে নিজেদের বিনিয়োগ কমিয়ে এনেছে। যেসব বিল-বন্ডের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেগুলো নবায়ন করেনি। আবার মেয়াদ পূর্ণ হয়নি—এমন অনেক বিল-বন্ডও ব্যাংকগুলো নগদায়ন করে ফেলছে। সেই সঙ্গে ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অব্যাহতভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় দেশের ব্যাংক খাতের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে ব্যাংকে থাকা নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জুলাই মাসের অস্থিরতা। এ সময় পাঁচ দিনের ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, তিন দিন ব্যাংক বন্ধ থাকা এবং দেশজুড়ে অস্থিরতার কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রমে সাধারণ মন্দা নেমে আসে। এ ছাড়া বর্তমানে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মানুষের হাতে সঞ্চয় থাকছে না। ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়ার পেছনে এটিরও ভূমিকা রয়েছে।
জানা গেছে, মেয়াদি আমানত হলো দেশের ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের প্রধান উৎস। দেশের ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৮৮ শতাংশই মেয়াদি। গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত এ অর্থ থেকেই ঋণ বিতরণ করা হয়। গত জুলাই শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৩ হাজার ২০৮ কোটি টাকা ডিমান্ড বা তলবি আমানত। বাকি ১৫ লাখ ৪০ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা বিভিন্ন মেয়াদের। এ ধরনের আমানতের সর্বনিম্ন মেয়াদ তিন মাস। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুলাইয়ে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও তলবি আমানতের পরিমাণ কিছুটা কমে গেছে। জুনের তুলনায় জুলাই মাসে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ বাড়লেও কমে গেছে তলবি আমানতের পরিমাণ। এ সময় ব্যাংকগুলোর তলবি আমানতের পরিমাণ কমেছে ১৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর চলতি হিসাবে থাকা আমানতকে তলবি শ্রেণিতে রাখা হয়।
জানা গেছে, সামগ্রিকভাবে আমানত প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ব্যাংকগুলোর জন্য গত দুই বছর একদমই ভালো যায়নি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৪ লাখ ৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে তা ১৪ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সে হিসেবে এক বছরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৭৯ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২০২৩ সালে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। যদিও আলোচ্য সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি হারে।
এ প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০২২ সাল বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতি বিভিন্নমুখী সংকটের মধ্য দিয়ে পার করেছে, যা ২০২৩ সালেও বহাল ছিল। আর চলতি বছরের শুরুতে নির্বাচন এবং সবশেষ জুলাইয়ে সংঘটিত অস্থিরতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের ব্যাংক খাতের আমানতের ওপরও। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে গেছে। এ ছাড়া নেতিবাচক বিভিন্ন সংবাদের কারণে কিছু গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো অর্থ থাকছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংকে আমানত কিছুটা কমে গেছে। তবে বর্তমান গভর্নরের নানামুখী উদ্যোগে আমানতের সুদহার বাড়ায় ব্যাংকের আমানত ধীরে ধীরে বাড়ছে। আশা করি, আগামীতে তা আরও বাড়বে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সাংবাদিকদের বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাতের বাইরে চলে গেছে। যে কারণে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনে সীমা আরোপ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত চলে এসেছে। যার ফলে টাকা তোলার সীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে ব্যাংক খাতে মানুষের আস্থা আবার বাড়ছে। আগামীতে ব্যাংকের আমানত আরও বাড়বে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।