ঋণ অনিয়ম, চেয়ারম্যান-এমডি অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মে ধুঁকছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আস্থার সংকট আরও গভীর হচ্ছে। এ জন্য ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) আমানতের সঙ্গে হারাচ্ছে আমানতকারীও। দুই বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারী হারিয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৭ হাজার। একই সঙ্গে ধার ও বিনিয়োগের টাকা ঋণ হিসেবে বিতরণ করায় আমানতের চেয়ে ঋণের ব্যবধান বাড়ছে। বর্তমানে ঋণের পরিমাণ আমানতের চেয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্থা হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমেছে প্রকৃত আয়। এসব কারণে আমানত ও ব্যক্তি আমানতকারীর হিসাব কমেছে। এ ছাড়া আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে সুদের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়াও কমার কারণ হতে পারে বলে তারা জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন শেষে দেশের কার্যরত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৭০৬। আর চলতি বছরের জুন শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩৭ জনে। অর্থাৎ দুই বছরের ব্যবধানে এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারী হারিয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৯৬৯ জন। শুধু তাই নয়, এক বছরের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারী হারানোর সংখ্যা ৮৮ হাজার ৩২৪। গত বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতকারী ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার ৬১ জন।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতকারী কমে যাওয়ার কারণ দুটি। এর মধ্যে প্রধান কারণ সুশাসনের অভাব। ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। পাশাপাশি ঋণ কেলেঙ্কারিসহ অন্যান্য ঘটনা তো আছেই। এজন্য আমানতকারীদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অন্য কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণি কষ্টে আছে। তাদের আয় বাড়ছে না। তাই তারা আমানত তুলে হিসাব বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ হিসাব চালু থাকলে এর চার্জ দিতে হবে।
তবে আশার দিক হচ্ছে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কিছুটা বাড়ছে। ২০২৩ সালের জুন শেষে এসব প্রতিষ্ঠানের আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত বেড়েছে ৪৩৩ কোটি টাকা। যদিও তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত বেড়েছে ৮১২ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।
এদিকে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানত ও ঋণের ব্যবধান দিনদিন বাড়ছে। চলতি বছরের জুন শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ১১৬ কোটি টাকায়। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণ করেছে ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি ২৯ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে এই ব্যবধান ছিল ২৭ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। ওই সময় আমানত ছিল ৪৪ হাজার ৬৮৩ কোটি, আর ঋণ ৭২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ব্যবধান বেড়েছে ২ হাজার ৪৬ কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানাধীন। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই রয়েছে তারল্য সংকটে। অনেক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক।
খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতের সুদহার বেঁধে দেওয়ায় ব্যক্তি আমানতকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমানত ও ঋণে সুদহার বাড়তে থাকায় বেশি মুনাফার আশায় আমনতকারীরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফিরতে শুরু করেছেন।