দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন বাড়লেও সে তুলনায় বাড়ছে না রপ্তানি। চলতি মৌসুমে রাজশাহীসহ আম উৎপাদনকারী জেলাগুলোয় উৎপাদন হয়েছে বিভিন্ন জাতের ৪০ হাজার টন রপ্তানিযোগ্য আম। এই মৌসুমে চীনসহ বিশ্বের ৩৮টি দেশে ৫ হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে নানা জটিলতায় গন্তব্য দেশগুলোতে আম রপ্তানিতে সাফল্য নেই। এতে হতাশ রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষি।
গত বছর বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৩২১ টন। তার আগে ২০২৩ সালে রপ্তানি হয় সাড়ে ৩ হাজার টন। এবারে আম রপ্তানির সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে পাঁচ হাজার টন; কিন্তু এ বছর মৌসুম শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত ৭৮০ টন আম রপ্তানি হয়েছে। এ নিয়ে হতাশ রাজশাহী অঞ্চলের আমপ্রধান বিভিন্ন জেলার বাণিজ্যিক চাষি, যারা বাড়তি বিনিয়োগ করে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছেন। আমচাষি বলছেন, আম রপ্তানি প্রসার, প্রণোদনা ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে সরকারি একটি প্রকল্প রয়েছে; কিন্তু এই প্রকল্পের কোনো সুফল রাজশাহী অঞ্চলের আমচাষি পাচ্ছেন না।
আমচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উদাসীনতাসহ নানা কারণে আম রপ্তানিতে গতি নেই। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে প্যাকিং হাউস না থাকায় প্রথমে আম নিয়ে যেতে হয় ঢাকায়। এতে অন্তত ১০ শতাংশ আম নষ্ট হয়। এ ছাড়াও বাড়ে পরিবহন খরচ। এসব বাড়তি ঝামেলার কারণে আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা রপ্তানিতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। রাজশাহী অথবা চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্যাকিং হাউস তৈরির দাবি চাষিদের অনেক দিনের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছর রাজশাহী অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৭২০ টন। এর মধ্যে রাজশাহীতে ২০০ টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬ হাজার টন, নওগাঁয় ৫০৫ টন ও নাটোরে উৎপাদন হয়েছে ১৫ টন। এর বিপরীতে চলতি মৌসুমে গত শনিবার পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৭৮০ টন আম রপ্তানি হয়েছে ১৪ দেশে। এর মধ্যে ২৮ মে ৩ টন চীনে রপ্তানির মধ্য দিয়ে চলতি বছর আম রপ্তানি শুরু হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব জানান, রপ্তানির জন্য গুড অ্যাগ্রিকালচার প্রোডাক্ট (গ্যাপ) প্রটোকলে আম উৎপাদন করতে হয়। এ জন্য বাড়তি খরচ হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এবার রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছেন ১০৭ জন বাণিজ্যিক চাষি।
রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অ্যাগ্রো ফুড সমিতির সভাপতি আনোয়ারুল হকের ভাষ্য, রাজশাহী অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করেন শতাধিক বাণিজ্যিক চাষি; কিন্তু সরকারের জটিল রপ্তানি নীতিমালা ও অবকাঠামোর অভাবে আম রপ্তানিতে গতি আসছে না।
কৃষি বিভাগ ও চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আম রপ্তানি উৎসাহিত করতে ‘রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন’ নামে সরকারি একটি প্রকল্প রয়েছে, যার অধীনে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে সহায়তা করা হয় চাষিদের।
রাজশাহী অঞ্চলের আম রপ্তানির প্রধান সমস্যা হলো স্বাস্থ্য সনদ (ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট) জটিলতা। কোয়ারেন্টাইন জটিলতাও আছে। আম রপ্তানির জন্য ফিটোস্যানিটারি সনদ প্রয়োজন হয়, যে প্রক্রিয়া বেশ জটিল। দেশে পর্যাপ্ত হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নেই। ইউরোপসহ অনেক দেশ আমদানির আগে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট চায়, যা দেশে শুধু ঢাকাতেই রয়েছে। আম রপ্তানিতে বিমান ভাড়াও বেশি। নীতি সহায়তার অভাবও এক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়।
শুধু তাই নয়, আম সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। শীতলীকরণ সুবিধার অভাব রয়েছে। পর্যাপ্ত প্যাকেজিং এবং গ্রেডিং ব্যবস্থা নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে মান অনুযায়ী প্যাকেট ও গ্রেডিং না থাকায় দাম কমে যায়। বাজার সংযোগেও রয়েছে দুর্বলতা। বিদেশে ভালো বাজার থাকলেও সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে সে বাজারের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলা হয় না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, ‘চলতি বছর ৫ হাজার টন আম রপ্তানির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে আমরা আশা করছি এবার ৪ হাজার টন রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এখনো আরও দুই মাস সময় আছে।’
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে গত তিন বছরে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয় ৪ হাজার ৬৪৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৭ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২২ দশমিক ১১ শতাংশ। রাজশাহী অঞ্চলে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছিল ৫৫০ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ওই বছর রপ্তানি হয় ২২২ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, যা উৎপানের ৪০ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫২৮ মেট্রিক টন। ওই বছর রপ্তানি হয় ৬০৬ মেট্রিক টন, যা উৎপাদনের মাত্র ২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন কমে হয় ১ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন, যার মধ্যে রপ্তানি হয় ১৯৯ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
রাজশাহীর বিপন অ্যাগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক হাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘আম রপ্তানির কয়েকটি ধাপ আছে। তবে নিরাপদ স্থান, প্যাকিং, গ্রেডিং, কার্গো বিমান ইত্যাদি সমস্যার কারণেই আমরা আম উৎপাদন থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আগে আমের চাহিদা বেশি ছিল, তখন কৃষক ছিল না। এখন কৃষক আছে; কিন্তু দক্ষ লোক ও সরকারি সহায়তা খুব একটা নেই। এ জন্যই আমাদের আম রপ্তানি কমে গেছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইয়াছিন আলী জানান, রাজশাহী অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে এই জেলায়। তিনি বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার প্রায় ৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে। এরই মধ্যে আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। আমরা ১৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছি। এরপর ঈদের ছুটিতে রপ্তানি হয়নি। এখন আবারও শুরু হবে। গত বছর ৩৩০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছি। এবার ৫০০-৭০০ মেট্রিক টন চেষ্টা করব। বাকি আমগুলো বিভিন্ন সুপারশপে পাঠানো হবে।’
আর রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, ‘রাজশাহী থেকে বিদেশে আম রপ্তানি এখনো শুরু হয়নি। ঈদের ছুটি ও অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে দেরি হচ্ছে। তবে এবার চীনে আম রপ্তানি হবে।’
এই কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘রাজশাহী থেকে আম রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। এর কারণ নিজস্ব কার্গো বিমান নেই। এক কেজি আম পাঠাতে ৫০০ টাকা পরিবহন খরচ পড়ে যায়। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে পাঠাতে এই খরচ কম। এ কারণে তারা বেশি পাঠাচ্ছে।’
মন্তব্য করুন