বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বর্তমানে প্রধানত একটি খাত—তৈরি পোশাকনির্ভর (আরএমজি)। অথচ সম্ভাবনাময় অন্য অনেক শিল্প রয়েছে, যেগুলো বৈচিত্র্যময় রপ্তানি বাজার গড়তে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন উচ্চ শুল্কারোপের প্রেক্ষাপটে এখনই সময় নতুন রপ্তানিমুখী খাতকে গুরুত্ব দেওয়া, বিশেষ করে দেশীয়ভাবে গড়ে ওঠা ফার্নিচার শিল্পকে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফার্নিচার বাজারের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বড় অংশজুড়ে রয়েছে অনিয়মিত ও ব্র্যান্ডবিহীন দোকান। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দেশীয় ব্র্যান্ড শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে এবং ফার্নিচার রপ্তানি ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হয়েছে।
২০১১-১২ অর্থবছরে যেখানে রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২৭ মিলিয়ন ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ১১০ মিলিয়ন ডলারে। বিশ্ববাজারে আধুনিক জীবনধারা, টেকসই পণ্যের চাহিদা এবং শহুরে আবাসনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব ফার্নিচার বাজারের পরিমাণ ৭৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
তবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সেখানে এখনো নামমাত্র—গড়ে বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি। এ তুলনায় ভিয়েতনাম, চীন ও পোল্যান্ড সরকারের কৌশলগত সহায়তায় এরই মধ্যে শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।
অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতার কারণে ফার্নিচার শিল্প বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে। মূল প্রতিবন্ধকতাগুলোর মধ্যে রয়েছে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অভাব, কাঁচামালের ঘাটতি ও উচ্চ আমদানি শুল্ক, রপ্তানিবান্ধব নীতির বাস্তবায়নে দুর্বলতা, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ইন্ডাস্ট্রির অনুপস্থিতি, প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহে জটিলতা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শুধু পোশাকের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বহুমুখী পণ্যের রপ্তানিতে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় শিল্পনীতি, আমদানি নীতি আদেশ, রপ্তানি নীতি ও ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসির পূর্ণ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
২০২৫ সালের আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজারে প্রবেশকারী বিভিন্ন পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এতে বড় ধাক্কা খেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান সেলিম এইচ রহমান বলেন, ‘শুধু পোশাকের ওপর নির্ভর করলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ঝুঁকি আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এখনই বহুমুখী রপ্তানির দিকে না গেলে, সামনে বড় সংকট দেখা দিতে পারে।’
তিনি মনে করেন, ফার্নিচার শিল্প হতে পারে পরবর্তী রপ্তানি চালিকাশক্তি। তার মতে, ‘এ খাতে দেশীয় সক্ষমতা, কর্মসংস্থান ও বৈশ্বিক চাহিদা—সবই রয়েছে। সঠিক কৌশল, নীতি সহায়তা ও রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে, আগামীদিনে এ খাত থেকে বহুগুণ বেশি রপ্তানি আয় সম্ভব।’
করণীয়: আংশিক রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোকে শতভাগ ব্যাংক গ্যারান্টির বিপরীতে শুল্ক বন্ড সুবিধা প্রদান করা জরুরি, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ও কাঁচামাল আমদানি সহজীকরণ, জাতীয় নীতিমালার বাস্তবায়নে আন্তরিকতা, শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়ন ও প্রণোদনা।
নতুন বাজারে প্রবেশ, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং টেকসই রপ্তানি আয় বৃদ্ধির জন্য এখনই সময় পোশাকনির্ভরতা কাটিয়ে নতুন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধারা গড়ে তুলতে হলে সরকার, উদ্যোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন