মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাল-বিল, নদী ও সমুদ্র থেকে আহরণের পাশাপাশি সর্বত্র বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। সরবরাহের নেই ঘাটতি। তবু বাজারে মাছের দামে আগুন। একইভাবে ডিম-মুরগির চাহিদার শতভাগ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। সর্বত্র সরবরাহও মিলছে। কিন্তু বছরজুড়েই অস্থির থাকছে গরিবের আমিষ খ্যাত এই পণ্য দুটির বাজার। আর গরু ও খাসির মাংস তো এখন শুধুই ধনীদের খাবার। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো—বিষয়টি নিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছে কালবেলা।
খাত সম্পর্কিত সার্বিক বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যা বেরিয়ে এসেছে, তাতে ক্ষেত্রবিশেষে সময়ে সময়ে মাছ-মাংস কিংবা ডিম-ব্রয়লারের বাজারে উৎপাদক-সরবরাহকারী তথা মধ্যস্বত্বভোগীর নানামুখী অপতৎপরতার তথ্য মেলে। এতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ বিল, পথে চাঁদাবাজির ঘটনা এবং ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে প্রতিবার এসব আমিষ পণ্যের হাতবদলের ঘটনাও বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী বাজার পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবে এসব ঘটনার সব কিছুই ছাপিয়ে গেছে ডিম-মুরগি ও মাছের দামে ফিডে অপ্রত্যাশিত মূল্যবৃদ্ধির উসকানি।
পোলট্রি, গবাদি ও মৎস্য খাতে দৈনন্দিন প্রতি ঘণ্টায় এই ফিডের ব্যবহার হচ্ছে। এই ফিড হলো প্রাকৃতিক পণ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি এক ধরনের পশুখাদ্য, যা গৃহপালিত কিংবা খামারের গরু, ছাগল এবং হ্যাচারিতে উৎপাদন করা মাছের বেঁচে থাকা ও দ্রুত বাড়ন্ত হওয়ার অন্যতম মৌলিক উপাদান। প্রান্তিক খামারিরা পোলট্রির জন্য প্রায় ৮০ শতাংশ, গরুর জন্য ৫ থেকে ১০ এবং মাছের জন্য ৫০ শতাংশ ফিনিশড ফিড কিনে থাকেন।
কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গুরুত্বপূর্ণ এই খাদ্য উপকরণের বা ফিড তৈরির সব ধরনের কাঁচামালের দাম বছরের ব্যবধানে বেড়ে প্রায় দিগুণ হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসিআইর এগ্রিবিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারী কালবেলাকে বলেন, ফিডের অন্যতম উপকরণ সয়াবিন মিলের ৮৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কাঁচামালের দাম ১২৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি ঘটেছে। যে ভুট্টা ৮০ ডলারে বিক্রি হতো, তা এখন ৩৫০ ডলারের কাছাকাছি। অন্যান্য কাঁচামালের আমদানি খরচও দ্বিগুণ হয়েছে। উপকরণের এই বাড়তি দামের প্রভাব পড়েছে দেশে ফিড উৎপাদনে। ইতোমধ্যে চাহিদার তুলনায় বাজারে উৎপাদন কমে গেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে কারখানা পর্যায়ে ফিড তৈরির খরচ অত্যধিক বেড়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোলট্রি, গবাদি ও মৎস্য খাতে যে ফিড ব্যবহার হচ্ছে, তার উপকরণ ভুট্টা, সয়াবিন ও ধানের কুঁড়ার ৭০ শতাংশই আমদানি হয়ে থাকে, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তার স্বাভাবিক সরবরাহে বাধা তৈরি করছে। অন্যদিকে, এসব ফিড আমদানিতে শিপিং খরচ গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তদুপরি দেশে ডলারের সংকটের উপদ্রব যোগ হয়েছে। ত্রিমুখী এই সংকটে ফিডের উপকরণ আমদানি কমে গেছে। যা আমদানি হচ্ছে, তার খরচও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে দেশের ফিড ইন্ডাস্ট্রিগুলোও ভালো নেই বলে দাবি করা হয়েছে।
এতে একদিকে যেমন উৎপাদকরা ফিডের উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন, তেমনি যারা উৎপাদন ও বাজারজাতে সক্রিয় রয়েছেন, তারাও চাহিদার তুলনায় ফিডের কম সরবরাহে সৃষ্ট ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছেন। ফলে সারা দেশে বাজারপর্যায়ে এসব প্রাণী ফিডের দামও বেড়েছে। এখন ডিম-মুরগি ও মাছের দামে তারই প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনগুলোর শীর্ষ সংস্থা বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্যানুসারে, গত এক দশকে দেশে ফিড শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটেছে ২৫ শতাংশেরও বেশি। এই সময় এ খাতে বড় বড় করপোরেট কোম্পানিরও অনুপ্রবেশ হয়েছে। বর্তমানে পোলট্রি, গবাদি ও মৎস্য—এই তিন খাত মিলে ফিডের বার্ষিক চাহিদা তৈরি হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এই বিপুল ফিড চাহিদার ৯৯ শতাংশই দেশে উৎপাদন হয়ে থাকে। যার ৭০ শতাংশের বেশি সরবরাহ জোগায় নুরিশ পোলট্রি ফিড, এসিআই, কাজী ফার্মস, প্রোভিটা ফিড, আফতাব ফিড, নিউ হোপ ফিড ও আমান ফিডের মতো স্থানীয় সাত কোম্পানি। পাশাপাশি ইউনাইটেড ফিড, সিটি পোলট্রি, সিপি বাংলাদেশ, আরআরপি এগ্রো, কোয়ালিটি ফিডস, এআইটি ফিডস, এজি এগ্রো ফিডসহ বাকি কোম্পানিগুলো চাহিদার বাকি অংশের জোগান দিয়ে থাকে। এ খাতে নিবন্ধিত মিলের সংখ্যা ২৬১টি। তবে এর মধ্যে লাইসেন্স নবায়নের মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছে ১৪০টি ফিড কোম্পানি। এ ছাড়া অনিবন্ধিত আরও দুই শতাধিক ছোট শিল্পও ফিড উৎপাদন করছে।
অন্যদিকে, দেশে পোলট্রি ফার্মিংয়ের পাশাপাশি মাছ ও গবাদি পশুর চাষ বেড়েছে। বর্তমানে শুধু পোলট্রি খাতেরই বিনিয়োগ প্রায় ৪ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। এটি বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ করে বাড়ছে। ফলে আগামী দশকে সংখ্যাটি দ্বিগুণ হওয়ার তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দুগ্ধ খাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে। দুগ্ধের বার্ষিক বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। ২০২৯ সালের মধ্যে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দেশের। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একটি জরিপে দেখা যায়, বর্তমানের প্রায় এক কোটি টন দুগ্ধের উৎপাদন সে সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ হবে। ফলে এ খাতগুলোয় প্রবৃদ্ধি অর্জনের নিয়ামক ভূমিকায় থাকবে দেশের ফিড সেক্টরই।
মন্তব্য করুন