দেশে সাধারণত আলু উৎপাদন মৌসুম শুরু হয় নভেম্বর মাস থেকে। আর ফলন গড়ায় জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে। এখন চলছে অক্টোবর মাস। অর্থাৎ আগের মৌসুমের ফলনও শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এখন বাজারে আলুর সরবরাহে যে ঘাটতি এবং দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে স্বেচ্ছাচারিতা শুরু হয়েছে, তা মৌসুম শেষ হওয়ারই একটা মনস্তাত্বিক বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এদিকে দেশে আলুর ব্যবহার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটা এখন শুধু খাবার পাতে তরকারি কিংবা ভর্তা হিসেবেই নয়, চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ছাড়াও শিল্প বা করপোরেটপর্যায়ে প্রক্রিজাত পণ্য হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে আলুর ব্যবহার যত বাড়ছে, তার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও সরবরাহও সমানতালে বাড়ছে। তবে এই উৎপাদন ও চাহিদার প্রকৃত পরিসংখ্যান বা সঠিক তথ্য নিরূপণ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে রয়েছে হরেক প্রশ্ন। তার প্রমাণও মেলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) তথ্যমতে, দেশে আলুর চাহিদা আছে ৯০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, গেল ২০২২-২৩ মৌসুমে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টন। কিন্তু বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) সেটি ৮৫ লাখ টনের বেশি নয়। আলুর বাজারে বর্তমানে তারও একটা বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, প্রতিবছর যে পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়, তার ৪০ ভাগ বীজ আলু হিসেবে হিমাগারে সংরক্ষণে রাখা হয়। আর চার ভাগ সংরক্ষণে থাকে দেশে গড়ে ওঠা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরিতে। এ ছাড়া প্রতিবছর কিছু পরিমাণ আলু রপ্তানিও হয়ে থাকে। আবার সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিপণনকালীন কিছু পরিমাণ আলু পচেও নষ্ট হয়। এ দুয়ের সম্মিলিত যোগফল মোট উৎপাদনের দুই থেকে তিন ভাগের কম হবে না।
এ তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে বাজারের ক্রেতার চাহিদা পূরণে উৎপাদিত আলুর মাত্র ৫৩ ভাগ সরবরাহ হওয়ার কথা। কিন্তু অভ্যন্তরীণ যে ৯০ লাখ টন চাহিদার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বীজ আলুসহ অন্যান্য বিষয়গুলো যুক্ত আছে কি না—সেটি কোনো মহল থেকে এখনো স্পষ্ট করা হয়নি।
মৌসুমের শেষ সময় এসে দেশে আলুর বাজারে যখন চাহিদা, দাম এবং সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে, তখন হঠাৎ আরও একটি নতুন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই আলু আমদানির পরিকল্পনা চলছে। যতদূর জানা গেছে, এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অনেক প্রতিষ্ঠান আমদানির অনুমতি চেয়েছে। যদিও এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে আলুর বাজারে লাগাতার অস্থিরতার বিষয়টি জোরেশোরে আলোচনায় ওঠে আসছে। কারণ, কৃষকের সাড়ে ১০ টাকায় উৎপাদিত আলু বর্তমানে ক্রেতাকে কিনতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৫০ টাকায়।
এ নিয়ে এখন উৎপাদক, পাইকার, খুচরা ব্যবসায়ী, হিমাগার মালিক এবং অন্যান্য মধ্যস্বত্বভোগীদের মধ্যে পারস্পরিক দোষারোপের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার প্রতি কেজি আলুতে ৩৬ টাকা বেঁধে দিয়েও দাম কার্যকর করতে পারছে না। এ অবস্থায় সরকার সমস্যার গভীরে না গিয়ে এবং কেউ দায়ী থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো আমদানিকেই সহজ সমাধানের পথ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলু নিয়ে এখন এক ধরনের রাজনীতিও শরু হয়েছে। চলতি সময়ে আলুর দর বৃদ্ধির কারণে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলছে। মূলত উৎপাদন খরচের সঙ্গে বর্তমান বাজার দরের ব্যাপক তফাত থাকায় এ আলোচনা তৈরি হয়েছে।
দাম বৃদ্ধির পেছনে হিমাগার মালিকরা জড়িত—এমন অভিযোগ থাকলেও হিমাগার মালিকরা দাবি করছেন, গত বছরগুলোতে টানা লোকসানের কারণে ৯৬ ভাগ হিমাগার ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। তাদের এখন আলু ক্রয় ও সংরক্ষণের ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে সংরক্ষণ মূল্য সমন্বয় করেছে হিমাগার ব্যবসায়ী সমিতি। গেল মৌসুমের উৎপাদিত আলু হিমাগারে সংরক্ষণ খরচ কেজিতে ৫ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন ও সংরক্ষণ পর্যায়ে দাম ২০ থেকে ২১ টাকার বেশি নয়। তাহলে সেই আলু পাইকারি পর্যায়ে ২৪ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩২ থেকে ৩৩ টাকার বেশি হওয়া যৌক্তিক নয়। সেখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলুর কেজি ৩৬ টাকা ঠিক করে দেওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। পাইকারি ও খুচরা বাজারে তো হিমাগার মালিকরা থাকেন না।
উৎপাদনের সময় : সাধারণত নভেম্বর মাসে আলু চাষ শুরু হয়। এর আগে জমি তৈরি সম্ভব হয় না। আবার নভেম্বরের পরে আলু লাগালে ফলন কমে যায়। এ জন্য বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মধ্য-কার্তিক (নভেম্বর প্রথম সপ্তাহ) এবং দক্ষিণাঞ্চলে অগ্রহায়নের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের (নভেম্বর মাসের মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহ) মধ্যে আলু লাগাতে হয়। আলু পরিপক্ব হতে ৮০ থেকে ১০০ দিন সময় লাগে। দেশি আলুর ক্ষেত্রে এ সময় আরও বেশি লাগে। সাধারণত, জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফসল উঠানো শুরু হয়, যা জাত ভেদে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত উত্তোলন করা যায়।
উৎপাদন ব্যয়: কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫১ পয়সা। এর মধ্যে জমি তৈরি বা চাষাবাদ; সার; বীজ; সেচ; কীটনাশক; শ্রমিক; জমির ভাড়া বা লিজ খরচ; ঋণের সুদ ও অন্যান্য খরচ রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস কালবেলাকে বলেন, আমাদের যে তথ্য সেটি আমাদের দিক থেকে। এখন ব্যবসায়ী বা হিমাগার মালিকরা যেটি বলছেন, সেটি তারা সেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাদের দিক থেকে বলতে পারেন। উনারা সারা দেশের খবর রাখেন বলে আমার মনে হয় না। যাই হোক, মূল বিষয় হচ্ছে ভোক্তারা বাজারে গিয়ে আলু কিনতে পারছেন কি না। এমনতো নয় বাজারে আলু নেই। হিমাগারে আলু নেই। তাহলে কেউ যদি অতি মুনাফার উদ্দেশ্যে দামের বিষয়ে কিছু করে থাকেন, সেটি প্রশ্ন উঠতে পারে। আমরা দেখিয়েছি এক কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের কত খরচ হয়েছে, সেখান থেকে শ্রমিক, পরিবহন ও হিমাগার খরচ মিলিয়ে বর্তমান সময়ে আলুর দাম কত হওয়া যৌক্তিক। উৎপাদন বা সরবরাহের ঘাটতি না থাকলেও যৌক্তিক দাম বাস্তবায়ন না হলে কারসাজির প্রশ্ন আসতে পারে।
আলুর বিকল্প গম, ভুট্টা চাষের বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষক যে ফসলে লাভ পাবেন, সে দিকে ঝুঁকবেন। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যে পরিমাণ ভুট্টার উৎপাদন বাড়ছে, তাতে আলুর জমিতে প্রভাব পড়বে না। বিকল্প হিসেবে আমরা কৃষকের হাতে উচ্চফলনশীল আলুর জাত দিচ্ছি, যা দিয়ে জমির পরিমাণ অল্প কিছু কমলেও উচ্চফলনশীল জাতের মাধ্যমে পূরণ করা যাবে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (বাজার সংযোগ-১) প্রণব কুমার সাহা কালবেলাকে বলেন, উৎপাদনের তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাজার পরিস্থিতিতে সব পক্ষের তথ্য-উপাত্ত্য নিয়ে আমাদের দপ্তর আলুর মূল্য নিয়ে কাজ করেছে এবং একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করেছে, যা সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ করে ঘোষণা করা হয়েছে। হিমাগার মালিকদের তথ্য এক্ষেত্রে মাঠ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত তদারকি হচ্ছে।
বেশি দামের প্রভাবে বীজ আলু বিক্রির সম্ভবনা বাড়ছে। এক্ষেত্রে সরকার কোনো উদ্যোগ নেবে কি না? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, বাজারমূল্যের প্রভাবে বীজ আলুর বিক্রির সম্ভবনা আছে। তবে বীজ আলুর ক্ষেত্রে হিমাগার মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বীজ আলুর যৌক্তিক দাম নির্ধারণেরও কাজ চলছে। তবে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।