আবার ঈদের ছুটি। লাল বাসগুলো ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। কোলাহলপূর্ণ ক্যাম্পাসে সুনসান নীরবতা। শিক্ষার্থীদের কেউ পোঁটলা গুছিয়ে দৌড় দিয়েছে বাস ধরতে। কেউ ঢিমেতালে নিচ্ছে টিকিট কাটার প্রস্তুতি। তবে শেষ দিনেও আড্ডার সুযোগ হাতছাড়া করেনি কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে তাদের সঙ্গে বসেছিলেন সিফাত রাব্বানী।
কলা অনুষদের সামনে দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বন্ধুদের দেখা। এ ছুটির লগ্নেও গোল হয়ে আড্ডায় গড়াগড়ি খাচ্ছে দেখছি। আমাকে দেখে গলা ছেড়ে চিৎকার ছাড়ল আবির।
আবির : আরে বন্ধু! অনেক দিন পর! পরীক্ষা তো শেষ। তার চেয়ে বেশি খুশি হলাম তোমাকে দেখে।
হাসি ও হাসানোর মানুষ রিফাত সবাইকে থামিয়ে সাধু-সন্ন্যাসীর মতো হাঁক ছাড়ল—
রিফাত : পরীক্ষা নেবেন সৃষ্টিকর্তা, ক্যাম্পাসে কেন পরীক্ষা থাকবে রে!
চাকতি : সবাই বাড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছে। কতদিন পর মায়ের সঙ্গে দেখা হবে।
শান্তা : কল্পনায় সব দেখা যাচ্ছে। একদম পরিষ্কার। ছেলেমেয়ে ফিরে এলো মায়ের কাছে। মা সবার আগে কী করবে? চুলে হাত বুলিয়েই বলবে, কীরে, মাথায় তেল দ্যাস না কয় বছর!
রিফাত : আরে যাক যাক। এসব আর কয়দিন! দুদিন না যেতেই ফিরবে আবার। হলের খাবার আর ছারপোকাকে সবাই মিস করে। ভালো জিনিস বেশি দিন পেটে সইবে না।
আবির : ঠিক। আমাদের কলেজের তৌহিদ স্যার আমেরিকা গিয়ে ছয় মাস ছিল। পরে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছে। সেই দেশের বার্গার নাকি তার ভালো লাগে না।
শান্তা : আচ্ছা, কারও বাসায় জামা কিংবা ব্যাগের সঙ্গে ছারপোকা চলে গেলে বাড়ির লোক এগুলোকে আবার বুড়ো উকুন ভাববে না তো?
চাকতি : এটা একটা গবেষণার বিষয়। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় কিছু উকুনই হয়তো ছারপোকায় পরিণত হয়েছে। উকুনের ডিএনএ তথা জীবন রহস্য উন্মোচন করে বিজ্ঞানী আলবার্ট ডারউইন বলেছেন...।
বিদ্রুপ ধরতে খানিকটা সময় লাগল বাকিদের। পরে ঝাড়া সাড়ে সাত সেকেন্ড হাসির ফোয়ারা ছুটল।
আবির : আমি এখনো নিশ্চিত নই গ্রামের বাড়ি যাব কি না। তবে এটা নিশ্চিত, আজ জ্যাম ঠেলে মিরপুরে পৌঁছানোর আগে সবাই যার যার বাড়ি পৌঁছে যাবে।
রিফাত : এ বিষয়ে তোর আর কোনো স্যারের কোনো অভিজ্ঞতা আছে?
বাকিরা হেসে উঠলেও আবির চোখ কুঁচকে ভাবতে লাগল, তার কলেজের কোনো স্যার আমেরিকা থেকে এসে ঢাকার জ্যাম নিয়ে কিছু বলেছিলেন কি না।
তুন্না চুপচাপ স্বভাবের। বোবা সেজে শত্রু বাড়াতে চায় না। কিছু জিজ্ঞেস না করলে মুখ ফোটে না তার।
তুন্না : কোরবানির ঈদ তো চলে এলো, গরু কোরবানির আগে মনে হয় নিজের সিজি-ই কোরবানি দিয়ে ফেললাম! ফলাফল ডাউন। আব্বা বলছিল রেজাল্ট ভালো হলে একটা আইফোন পেতেও পারি। আব্বার অনেকগুলো টাকা বাঁচিয়ে দিলাম মনে হচ্ছে।
তুন্নার আচমকা ছোড়া গুগলিতে সবাই যার যার পেটে জমিয়ে রাখা বাতাস বের করে দিল একযোগে। তবে সেটা মুখ দিয়ে। হাসির ছলে।
রিফাত : ফিন্যান্স বিভাগ হলো রয়েল বিভাগ। ভেবেছিলাম রয়েল বিভাগে পড়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো সাহসী হব। সিজি এগোবে বাঘের গতিতে। কিন্তু আমারও একই দশা।
চাকতি : একদম! তুই আমাদের সামনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর গার্লফ্রেন্ডের সামনে ডোরাকাটা বিড়াল।
প্রসঙ্গ দ্রুত ঘোরাতে আবিরের দিকে বল ছুড়ে দিল রিফাত।
রিফাত : সবাই ভেবে দেখেছিস? আমরা সবাই সিঙ্গেল। আবির এখনো সিঙ্গেল। আমার ধারণা কিছু লুকাচ্ছে ও। তা না হলে ওর একটা গতি তো আমাদের করতে হয়। এটা রীতিমতো আমাদের বন্ধুগত দায়িত্ব।
তৎক্ষণাৎ কবি হয়ে গেল আবির—
আবির : মনের মধ্যে যে সিদ্ধান্ত পেরেক দিয়া গাঁথিয়া দিয়াছি একেলা থাকিবার, ওই সিদ্ধান্ত হইতে এই আশিকুজ্জামান আবিরকে এক পা পিছু হটাইতে পারিবে না কেহ। আমি অবিচল! স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল!
শান্তা : তার মানে আসলে তুই সুবিধা করতে পারছিস না।
আবির : সুবিধাবাদী নই আমি হে তরুণী!
চাকতি : ও, তাহলে তুমি সুবিধাবঞ্চিত। ঈদে এবার তোকে জামাটামা কিনে দেব?
আবির : আমার কলেজের এক স্যার...।
থেমে গেল আবির। বাক্য শেষ না হোক, হাসি শুরু হতে আর বাধা রইল না।
পরিশেষে চুপচাপ থাকলেও যে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না, বুকের তাজা পকেট দিয়ে সেটার প্রমাণ দিল তুন্না। তাকে ইঙ্গিত করে শান্তা বলল—
শান্তা : তুন্না, কম বললে তো মুখের ব্যায়াম হবে না। হাকিম চত্বরের হালিম খাওয়াবি সবাইকে চল। জানিস তো, খেলে মুখের ব্যায়াম হয়।
অগত্যা কী আর করা। ছুটির শুরুতে আর কারও মন ভাঙতে চাইল না তুন্না। রাজি হলো হালিমসংক্রান্ত প্রস্তাবে।
বাটির শেষ হালিমটুকু যখন আর চামচে উঠছিল না, তখন বাধ্য হয়েই ইস্তফা দিল সবাই। এবার ভিসি চত্বর থেকে লাল বাসে চড়ে যে যার গন্তব্যে।
মন্তব্য করুন