সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বিকল্প হিসেবে রাখলেও আগামীকাল বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনেই মহাসমাবেশ করতে চায় বিএনপি। অনুমতি নিয়ে জটিলতা না কাটলেও এরই মধ্যে ঢাকায় বিপুল জনসমাগমের সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দলটি। সর্বোচ্চ জমায়েত নিয়ে এই কর্মসূচিতে যোগ দিতে তৃণমূলে বার্তা দেওয়া হয়েছে। শেষ সময়ে গ্রেপ্তার কিংবা কোনো রকম বাধা এড়াতে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলীয় নেতাকর্মীরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেছেন। আগেভাগে রাজধানীতে পৌঁছে গেছেন অনেকেই। একদফার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে এই কর্মসূচি সফল করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মহাসমাবেশের বিষয়টি অবহিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে তিন দিন আগে চিঠি দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তবে ডিএমপির পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে মহাসমাবেশের তারিখ পরিবর্তনের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু ২৭ জুলাই মহাসমাবেশের কর্মসূচি পালনে দলের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে বিএনপি।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির সমাবেশের অনুমতি নিয়ে মঙ্গলবার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আলোচনা করেছেন। তবে সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সপ্তাহের শেষ দিন বিবেচনায় বিএনপিকে তাদের সমাবেশের তারিখ পরিবর্তনের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তারা সেটা না করলে শেষ সময়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নানা শর্তে সমাবেশের অনুমোদন দেওয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা তৃতীয় কোনো ভেন্যুতে এই অনুমোদন আসতে পারে। বিএনপির সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘এখনো বিষয়টি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। হলে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
এদিকে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ধারণা করছেন, এবারও শেষ মুহূর্তে অনুমতি দেওয়া হতে পারে। তবে সেদিকে তাকিয়ে না থেকে যে কোনো মূল্যে ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে এরই মধ্যে দলীয় প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘একদফার আন্দোলন এখন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। মহাসমাবেশ সফল করতে জনগণ নেমে পড়েছে। বিপুল জনসমাগম হলেও এই কর্মসূচি হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘কে কী বলছে, সেটা বিষয় নয়। মহাসমাবেশের তারিখ পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।’
জানা গেছে, নয়াপল্টনকে ঘিরেই চলছে বিএনপির মহাসমাবেশের প্রস্তুতি। এর পাশাপাশি আরও ১১টি স্পটে জমায়েত হয়ে আলাদা সমাবেশ করবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জোট ও দলগুলো। সব মিলিয়ে মহাসমাবেশকে রাজধানীর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। কর্মসূচি সফল করতে বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা করছেন। গতকাল মঙ্গলবার দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সূত্র জানায়, মহাসমাবেশের দিন কোন সংগঠনের নেতাকর্মীরা কোথায় অবস্থান করবেন, তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এই কর্মসূচিতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মুক্তিযোদ্ধা দল, শ্রমিক দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দল, ওলামা দল, জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) এবং মহিলা দল নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে সমবেত হবে। এ ছাড়া পেশাজীবী সংগঠনের মধ্যে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি), জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব), অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (অ্যাব), এগ্রিকালচারিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (অ্যাব), ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব), বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটও সমাবেশে যোগ দেবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মহাসমাবেশ সামনে রেখে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দিন-রাত বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অবস্থান করছেন। আসা-যাওয়ার মধ্যেই সেখানে দফায় দফায় চলছে প্রস্তুতি সভা।
জানা গেছে, ইতোমধ্যে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিভাগীয় ও বৃহত্তর ঢাকার নেতাদের সঙ্গে যৌথ সভা করেছেন। এসব সভায় সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীদের ঢাকায় জমায়েত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরিবহন বন্ধ, ঢাকার প্রবেশপথে বাধা কিংবা হামলা হলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে সেসব বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে সংঘাতে না জড়াতে নেতাকর্মীদের বলে দেওয়া হয়েছে। মেডিকেল টিম, শৃঙ্খলা কমিটি, আপ্যায়ন কমিটি, মঞ্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমাবেশে আগতদের জরুরি চিকিৎসাসেবার বিষয়ে সভা করেছে ড্যাব।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস কালবেলাকে জানান, মহাসমাবেশ সফল করতে গত সোমবার বিএনপির যৌথসভা হয়েছে। মেহনতি মানুষের জাগরণের লক্ষ্যে একই দিন নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কৃষক দল, শ্রমিক দল, জাসাস, তাঁতী দল এবং মৎস্য জীবী দলেরও যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সফল করতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।’
তিনি জানান, ‘ঢাকার মহাসমাবেশ সফল করতে যশোর ও রাজশাহীতে পূর্বঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে।
ঢাকামুখী বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা : এদিকে বৃহস্পতিবারের মহাসমাবেশে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা এরই মধ্যে ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, এর আগে ঢাকায় বিএনপির বড় কর্মসূচির আগে গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এবারও একই রকম আশঙ্কা করছেন দলের নেতাকর্মীরা। এ কারণে আগে ভাগেই ঢাকামুখী হয়েছেন তারা।
গত ২২ জুলাই তারুণ্যের সমাবেশে যোগ দিতে নাটোর থেকে ঢাকায় আসেন বিএনপি নেতা সাইদুর রহমান সাধু। মহাসমাবেশে যোগদানের জন্য এখনও রাজধানীতেই অবস্থান করছেন বলে তিনি জানালেন।
তার মতোই বিভিন্ন জেলার কয়েকজন নেতা জানান, ঝামেলা এড়াতে আগেই ঢাকায় এসে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছেন।
তবে এখন পর্যন্ত পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানি বা সমাবেশের প্রস্তুতিতে বাধা দেওয়ার কোনো অভিযোগ নেই বিএনপি নেতাদের।
যদিও রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও জোনের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা উচ্চপর্যায় থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোর নির্দেশনা পেয়েছেন। তা ছাড়া অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের জন্যও নির্দেশনা এসেছে।
১১টি স্পটে হবে মহাসমাবেশ : যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আগামীকাল ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের আশপাশে আরও ১০টি এলাকায় সমমনা দল ও জোটগুলো পৃথক সমাবেশ করবে। এভাবে বিপুলসংখ্যক লোক জড়ো করে সরকারকে কড়া হুঁশিয়ারি দিতে চায় বিএনপিসহ শরিকরা। এর মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ মৎস্য ভবনের সামনে, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি যৌথভাবে মতিঝিলে, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি পান্থপথে, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ পল্টনে, ১২ দলীয় জোট বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কের সামনে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট পল্টনের আল-রাজি কমপ্লেক্সের সামনে, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, বাংলাদেশ লেবার পার্টি পুরানা পল্টনে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে এবং আমার বাংলাদেশ (এবি পার্টি) পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘একদফা ঘোষণার পর যুগপৎ আন্দোলনের বার্তাটি খুব পরিষ্কার যে, অনতিবিলম্বে এই সরকারকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার রাস্তা খুলতে হবে। আশা করি, শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতে সরকার ও সরকারি দল কোনো উসকানি বা বাধা প্রদান করবে না। কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে তার দায় সরকার ও সরকারি দলকেই বহন করতে হবে।’
মন্তব্য করুন