সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হয়ে মিরপুরের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট আলোক হেলথ কেয়ার অ্যান্ড হসপিটালে যান আব্দুল্লাহ (ছদ্মনাম)। এ সময় জরুরি বিভাগে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। আহত ব্যক্তির শরীরের কাটা-ছেঁড়া বিভিন্ন স্থানে সেলাইসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন একজন নার্স। এমনকি এই রোগীর পুরো চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। কিন্তু তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া বিলে দেখানো হয়েছে, সব কিছু করেছেন একজন চিকিৎসক। এমনকি ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) স্বাক্ষরও রয়েছে চিকিৎসকের। সম্প্রতি পরিদর্শনে গিয়ে আলোক হেলথ কেয়ার অ্যান্ড হসপিটাল লিমিটেডের অভিনব এই প্রতারণার প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
চিকিৎসাসেবার নামে অলোক হেলথ কেয়ার অ্যান্ড হসপিটালের প্রতারণা এখানেই শেষ নয়। প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসা নিতে আসা সব রোগীকেই চিকিৎসা ব্যয়ের পাশাপাশি জরুরি বিভাগ ফি দিতে হয় ২০০ টাকা। পরিদর্শনের নামে আন্তঃবিভাগ ভর্তি রোগীদের পকেট থেকে হাসপাতাল প্রশাসন প্রতিদিন তুলে নেয় আরও ৬০০ টাকা। এ ধরনের অসংখ্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ জুন দুপুরে মিরপুর-১০-এ অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান। পরিদর্শনের সময় তিনি এসব অভিযোগের সুস্পষ্ট প্রমাণ পান।
রোগীদের সঙ্গে এসব প্রতারণামূলক কার্যক্রম আমলে নিয়ে তিনি ১১ জুন প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়, হাসপাতালের ল্যাবরেটরির রিয়েজেন্ট রাখার ফ্রিজে আইসক্রিম পাওয়া গেছে, যা ল্যাবরেটরি আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। গুরুতর শারীরিক নির্যাতনের শিকার একজন নারী রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি রাখলেও বিষয়টি স্থানীয় থানায় জানায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি ওই রোগীকে দুদিন দুবার পরিদর্শন দেখিয়ে ডা. রানা নামের একজন ২ হাজার টাকা বিল তুলেছেন। যদিও তিনি কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নন। আরেক নারী রোগীর মাইক্রোবায়োলজি রিপোর্টে অধ্যাপক মো. আব্দুর রহমানের স্ক্যান করা সই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটিও আইন অনুযায়ী অবৈধ। আরেক অস্ত্রোপচার রোগীর ফাইলে দেখা গেছে, সেখানে রোগীর প্রি-অ্যানসেথেটিক চেকআপ (অস্ত্রোপচারের জন্য রোগী উপযুক্ত কি না) নেই। এমনকি অস্ত্রোপচারের জন্য রোগী বা স্বজনদের কোনো অনুমতিও নেওয়া হয়নি।
তবে কার্যক্রম স্থগিত রাখতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া নির্দেশনা মানছে না আলোক হেলথ কেয়ার। সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। হাসপাতালের ওয়েবসাইটে দেওয়া ফোন নম্বরে কল করে রোগী ভর্তি করা যাবে কি না—জানতে চাওয়া হয়। হাসপাতালের কাস্টমার কেয়ার থেকে জানানো হয়, রোগী ভর্তিতে কোনো সমস্যা নেই।
প্রতিষ্ঠান বন্ধে অধিদপ্তরের নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালটির ডিজিএম (প্রশাসন) হাসিনুর রহমান বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গত মাসে পরিদর্শন করে গেছে, কিন্তু বন্ধেন নির্দেশনার বিষয়ে আমার জানা নেই। আমাদের হাসপাতালের সব কার্যক্রম চালু আছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ২০১৮ সালের ৩ জুলাই মেয়াদোত্তীর্ণ রিয়েজেন্ট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করায় আলোক হাসপাতালকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তখন অভিযানটি পরিচালনা করেন র্যাবের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম। এর পরও প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ও অপতৎপরতা যেন আরও বেড়ে গেছে। এমন কি তারা নারী ও শিশুদের চিকিৎসায় অনুমোদনহীন একটি হাসপাতাল পরিচালনা করছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, ‘আমি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি, তবে যেসব ভর্তি রোগী আছেন, তাদের ছেড়ে দেওয়ার পর। নিয়ম অনুযায়ী তারা হাসপাতাল বন্ধ করে অভিযোগগুলোর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেটি জানিয়ে অধিদপ্তরকে চিঠি দেবে। এরপর অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল আবার হাসপাতালে যাবে, তারা সন্তোষজনক প্রতিবেদন দিলে তবেই হাসপাতালের কার্যক্রম চালু করা হবে।’
সার্বিক বিষয়ে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের চিকিৎসাসেবা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটি প্রতারণার শামিল। নার্স দিয়ে চিকিৎসা করানো, ইমার্জেন্সি ফিস, প্রশাসনের লোক ভিজিট করে টাকা নেওয়া এগুলো আশ্চর্যজনক বিষয়। কোথাও কোথাও আয়া দিয়ে নার্সের কাজও করানো হচ্ছে, স্বাস্থ্য প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব ঘটে চলেছে, যা গ্রহণ যোগ্য নয়।’