জনপ্রশাসনে বঞ্চনা ও বৈষম্যের চরম নজির সৃষ্টি করেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সচিব থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পর্যন্ত ‘আওয়ামপন্থি’ কর্মকর্তারাই দাপট দেখিয়েছেন। এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের শিক্ষাজীবনে রাজনৈতিক মতাদর্শ বিবেচনায় নেওয়া হতো। যেসব কর্মকর্তাকে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার মনে করা হতো, তাদের নিয়মিত পদোন্নতি আটকে রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সংস্থার পদায়ন থেকে বঞ্চিত রেখেছে। ফলে মেধাভিত্তিক সুশৃঙ্খল ও জনকল্যাণমূলক প্রশাসন গড়তে ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তার অভাব দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জনপ্রশাসন ঢেলে সাজাতে গিয়ে একরকম ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ অবস্থা দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের প্রশাসনকে দলীয়করণের বড় উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন আওয়ামীপন্থি শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রশাসনকে দলের হাতিয়ারে রূপান্তর করে গেছেন। প্রশাসনকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সাজানোর পরিকল্পনা তিনিই করেছিলেন। ২০২১ সালের ৪ মার্চ তিনি মারা যান। পরবর্তী সময়ে পুরো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল মিয়ার হাতে। মুখ্য সচিব হওয়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ছিলেন। মুখ্য সচিব পদোন্নতি পেয়ে তিনিই দেশের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন। স্বয়ং মন্ত্রিপরিষদ সচিবরাও তার কাছে অসহায় ছিলেন। প্রশাসনের সর্বস্তরে তোফাজ্জলের পছন্দের কর্মকর্তারা পদায়িত হয়েছেন। তার আক্রোশের কারণে এক শ্রেণির কর্মকর্তাকে বিএনপি-জামায়াত আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয়। তাদের ভালো পদায়নও করা হয়নি। এমন দলীয়করণের কারণে যোগ্য কর্মকর্তা সৃষ্টি হয়েছে কম। ফলে আগামী কয়েক বছর দেশ দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তার সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ আওয়ামী লীগের শাসনামলে পিছিয়ে থাকা কর্মকর্তারাই এখন প্রশাসন চালানোর দায়িত্ব নিচ্ছেন। এসব কর্মকর্তাকে ধীরে ধীরে প্রশাসনের সব স্তরের প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সাবেক কনসালট্যান্ট মো. ফিরোজ মিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় অনেক সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তারা বঞ্চিত থেকেই অবসরে গেছেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে ফিরিয়ে এনে নিয়োগ দিয়ে প্রশাসন ঠিক করার দায়িত্ব দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রশাসনের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে যোগ্য কর্মকর্তা দিতে পারলে নিচের দিকে তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা দিয়েও চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে বড় পদগুলো যোগ্য ও সৎ কর্মকর্তার প্রয়োজন বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রশাসন সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে। তারা স্বল্পমেয়াদি সংস্কারে হাত দিতে পারে। এতে মৌলিক পরিবর্তনগুলো শেষ করা সম্ভব। অর্থাৎ প্রশাসনবিষয়ক আইন-বিধিবিধান সংশোধন করে দপ্তর সংস্থাগুলো কাঠামো ঠিক করতে হবে। বর্তমান সরকার ও প্রশাসনকে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।’
মাঠ প্রশাসনে শতভাগ অনুগত কর্মকর্তা:
জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, মাঠ প্রশাসন বিশেষ করে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকের (ডিসি) পদায়নে শতভাগ দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় নিয়েছে আওয়ামী সরকার। ডিসি পদে পদায়ন করে প্রজ্ঞাপন জারির পর ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন মৌখিক অভিযোগে বেশ কয়েকজনের পদায়নও বাতিল করা হয়। এসব ঘটনা প্রশাসনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। প্রশাসনের শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালনে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনার পদের অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশকে আওয়ামী প্রশাসন সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত রেখেছে। এসব কর্মকর্তা এখন প্রশাসনের বড় দায়িত্বে গেলে ভালো করে প্রশাসন চালানো তাদের জন্য কঠিন হবে।
প্রকল্পের কাজেও সুযোগ হয়নি অনেকের:
গত ১৬ বছর বিএনপি-জামায়াত সন্দেহে শতশত কর্মকর্তাকে ছোট-বড় সব ধরনের প্রকল্পের কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়েছে। প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ উন্নয়নমূলক কাজের আদ্যপান্থ শেখার ক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের নেওয়া প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সব প্রকল্পেই ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করা কিংবা দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের আধা-সরকারিপত্রের (ডিও) মাধ্যমে পিডি নিয়োগ হতো। ফলে এসব প্রকল্প লুটপাটের মহাযজ্ঞ হিসেবে পরিচিত।
প্রশিক্ষণ ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ মেলেনি:
কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দেশে-বিদেশে নানারকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ এসব প্রশিক্ষণের সুযোগ মিলত শুধু সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিত দলবাজ কর্মকর্তাদের। তারা প্রশিক্ষণের নামে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াতেন। এ ছাড়া বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা কিংবা মর্যাদাপূর্ণ ফেলোশিপের সুযোগও নিতেন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা। সিভিল সার্ভিসের একটি বড় অংশ সবসময় প্রশিক্ষণ ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে তাদের মধ্যে প্রশাসন চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী প্রশাসনের একচোখা নীতির ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে যোগ্য ও সৎ কর্মকর্তা সৃষ্টি হয়নি। এর পরিণতি আগামী কয়েক বছর ভোগ করবে বাংলাদেশের প্রশাসন।
দলীয় বিবেচনার বাইরে কেউই সচিব হননি:
প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেন সচিবরা। তারাই সরকারের সবরকম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। সচিবদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার ওপরই প্রশাসনের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। কিন্তু গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার সচিব পদোন্নতির ক্ষেত্রে শতভাগ দলীয় আনুগত্য বিবেচনা করেছে। নিরপেক্ষ সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তারা সচিব হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। আওয়ামী মতাদর্শের বাইরে কেউ সচিব হয়েছেন—এমন কোনো উদাহরণ নেই।
গড়ে ওঠেনি দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা:
সরকার কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের খুশি করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন এক শ্রেণির কর্মকর্তা। তারা সত্যিকারার্থে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও শুধু সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বয়ান নিয়ে তৎপর থাকতেন। তারা নিজেদের আওয়ামী লীগ প্রমাণে সবসময় মরিয়া ছিলেন। ফলে তাদের মধ্যে দক্ষতা তৈরি হয়েছে কম।
মেধাবী ও সচেতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই বহু সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে শতশত তরুণ কর্মকর্তাকে বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত রাখা হয়। মূলত বিএনপি-জামায়াত ঘরানার মনে করেই এসব কর্মকর্তাকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এসব কর্মকর্তার মধ্যে প্রশাসনিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অথচ এখন সেসব কর্মকর্তাই প্রশাসনের মূল নেতৃত্বে আসবেন। ফলে প্রশাসনে যেন দীর্ঘমেয়াদে সংকট তৈরি না হয়, সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে এনে নিয়োগ দিতে হবে।