সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচিতে রয়েছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, জনসম্পৃক্ত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায়ের লক্ষ্য তাদের। তবে চূড়ান্ত আন্দোলনের শুরুতেই কর্মসূচির ধরন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ২৮ জুলাই মহাসমাবেশের পর হঠাৎ করে ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কোন বিবেচনায় এবং কীভাবে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, নেতাকর্মীদের কাছে তা স্পষ্ট নয়। এমনকি দলের স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ নেতাও আগে থেকে এ বিষয়ে অবগত ছিলেন না বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ জুলাই বিএনপির মহাসমাবেশে যোগ দিতে সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকায় এসেছিলেন। সরকার পতন আন্দোলন জোরদার করতে তাদের বেশ কিছুদিন ঢাকায় অবস্থানের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলা হয়েছিল। মহাসমাবেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছিল। সেখান থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি দিয়ে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হবে—এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল; কিন্তু পরদিনই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ায় তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ঢাকার ভেতর থেকে কেন আন্দোলনকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য হয়নি।
জানা গেছে, মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হলেও বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে কর্মসূচি বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। মহাসমাবেশ থেকে কী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে, তা শুধু স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং ভারতে অবস্থানরত সালাহউদ্দীন আহমেদ জানতেন। এ ছাড়া অন্য কোনো নেতার কর্মসূচি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে শেষ সময়ে বিষয়টি অবহিত করা হয় এবং তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
জানা গেছে, মহাসমাবেশ থেকে কী ধরনের কর্মসূচি দেওয়া হবে—যুগপতের অন্যান্য শরিকের সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনা করেনি বিএনপি। শুধু তাই নয়, বিএনপির অধিকাংশ নেতাও এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন না। এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও বিষয়টি জানানো হয়নি। অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণার পর তাদের অনেকেই অবাক হয়েছেন। কারণ, আগে থেকে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কোন পয়েন্টে কীভাবে অবস্থান করা হবে—সে বিষয়ে ছিল না পরিষ্কার ধারণা। দলের সিনিয়র নেতাদের কে কোথায় অবস্থান কর্মসূচির নেতৃত্ব দেবেন, তাও জানানো হয় গভীর রাতে।
নেতাকর্মীরা মনে করেন, পর্যাপ্ত প্রস্তুতির অভাবে পূর্ণ সাংগঠনিক শক্তিতে রাজপথে নামতে না পারা এবং পুলিশ ও সরকারি দলের মারমুখী অবস্থানের কারণে অবস্থান কর্মসূচি পুরোপুরি সফল হয়নি। এর মধ্য দিয়ে কর্মসূচি নির্ধারণে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, শুধু ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থানই নয়, এর আগেও কর্মসূচি নির্ধারণে এমন সমন্বয়হীনতা দেখা গেছে। কখনো কখনো সিনিয়র নেতাদের মতামত না নিয়ে এবং তাদের অবহিত না করেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয় এবং শেষে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে কর্মসূচি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কর্মসূচি চূড়ান্ত করে দলের মহাসচিবকে জানিয়ে দেন। এরপর সেটা শরিকদের জানানো হয়।
এদিকে মহাসমাবেশের পর হঠাৎ করে অবস্থানের মতো সাংঘর্ষিক কর্মসূচি দেওয়ায় যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোও অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়। কেননা অভিযোগ আছে—শরিকদের সঙ্গে যথেষ্ট আলোচনা ছাড়াই ওই কর্মসূচি দেওয়া হয়।
একদফা আন্দোলন এবং নতুন কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সঙ্গে গতকাল বুধবার রাতে পৃথকভাবে বৈঠক করে বিএনপি। সেখানে মহাসমাবেশের পর হঠাৎ করে ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থানের মতো সাংঘর্ষিক কর্মসূচি দেওয়া নিয়ে শরিকরা প্রশ্ন তোলেন ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, মহাসমাবেশের মতো সফল কর্মসূচির পর কেন অবস্থানের মতো সাংঘর্ষিক কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের বাঘের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো? আর কর্মসূচি দেওয়া হলেও তা সফলে নেতাকর্মীরা কেন ব্যাপক সংখ্যায় মাঠে নামল না? এর মধ্য দিয়ে আন্দোলনের গতি ৯০ শতাংশ থেকে ফের ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। তাদের দাবি, প্রতিটি পয়েন্টে ২০-২৫ হাজার নেতাকর্মী জড়ো হলে পুলিশ এমন ভূমিকায় যেতে পারত না। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে এর সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে ভবিষ্যতে কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়। এ ছাড়া চূড়ান্ত আন্দোলন সফলে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকেও ২৯ জুলাইয়ের অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মী কম হওয়ার বিষয়টির নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানের কথা বলা হয়।
২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দৃশ্যত কিছুটা চাপে পড়ে যায় বিএনপি। কর্মসূচি ঘিরে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে সরকার পুরোনো কৌশলে তাদের চাপে রাখার চেষ্টা করছে বলে দলটির মূল্যায়নে উঠে আসে। এসব বিবেচনায় আপাতত আন্দোলনের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, মহাসমাবেশের মতো সফল কর্মসূচির পরও এখন পরিস্থিতি বিবেচনায় আন্দোলন পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়ন করতে হচ্ছে। ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিতে নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে গত সোমবার দেশের সব মহানগর ও জেলা সদরে জনসমাবেশ করে দলটি। এর মধ্য দিয়ে ঢাকায় আসা নেতাকর্মীদের যার যার এলাকায় ফেরত পাঠানো হয়। টানা কর্মসূচির পরিবর্তে বিরতি দিয়ে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচির পরিবর্তে আপাতত কেন্দ্র ও তৃণমূল ঘুরে ফিরে কর্মসূচি পালিত হতে পারে। চলতি আগস্ট মাসে এভাবে কর্মসূচি চলবে। সেপ্টেম্বর থেকে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো সমন্বয়হীনতা থাকলে সেটিও কাটিয়ে উঠতে চায় দলটি।
অবশ্য চলমান আন্দোলন সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, ‘একদফা দাবি আদায়ে মহাসমাবেশ ঘিরে নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসেছিলেন। তারা তো দিনের পর দিন ঢাকায় থাকবেন না। নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবেন—এটাই স্বাভাবিক। তারা ফিরে গিয়ে জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশের কর্মসূচি সফল করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি অহিংস আন্দোলন করছে। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সেই অহিংস আন্দোলনেও সরকারের মদদে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, গুলি করেছে, নেতাকর্মীদের পিটিয়ে আহত করেছে, গ্রেপ্তার করেছে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো বর্ষীয়ান নেতাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। এ রকম একটা পরিস্থিতি মোকাবিলা করে অনেক ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হচ্ছে। এখানে সমন্বয়হীনতার কোনো ব্যাপার নেই। একটা আন্দোলন এভাবেই চলে। এরকম একটা সরকারকে সরাতে এটা আন্দোলনের প্রথম ধাপ।’
বিএনপির একটি সূত্র বলছে, পুলিশের অনুমতি ছাড়া ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রশাসনের মনোভাব দেখতে চেয়েছিল বিএনপি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকার ও প্রশাসনের আচরণে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না—তা দেখতে চেয়েছিল বিএনপি। সে কারণে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হয়। তবে কর্মসূচিতে পুলিশ ও সরকারি দলের মারমুখী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রশাসনের আচরণে কার্যত কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে বিএনপির মূল্যায়নে উঠে এসেছে।
এ ছাড়া ওই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকায় সংগঠনের সক্ষমতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যও ছিল দলটির; কিন্তু অবস্থান কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কম হওয়ায় দায়িত্বে থাকা নেতাদের নামের তালিকাও তৈরি করছে বিএনপি। জানা গেছে, বিএনপির মূল্যায়ন তালিকায় অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে প্রত্যেক নেতাকর্মীর আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিটি স্থানে উপস্থিত নেতাদের তালিকার পাশে তাদের ভূমিকা, তাদের অনুসারীদের অবস্থান তুলে ধরা হচ্ছে। যারা অনুপস্থিত ছিলেন, সময়মতো হাজির হননি, গাফিলতি করেছেন, দলের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ কোন্দল সামনে রেখে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন—তাদের তালিকাও তৈরি করছে দলটি। এতে গাফিলতির কারণ, উদ্দেশ্য সবকিছু উল্লেখ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সাহসী আর ত্যাগীদের সামনে আনার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামীতে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর আগে দলের অভ্যন্তরীণ এ বিষয়গুলো আগে সমাধান করতে চায় দলের হাইকমান্ড। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ তালিকা ধরে কৈফিয়ত তলবের পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। প্রত্যাশিত জবাব না পেলে তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এদিকে বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। গ্রেপ্তার এড়ানো, বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া এবং সম্পদ রক্ষার জন্য তারা এমনটা করেন বলে তৃণমূলের কর্মীদের অভিযোগ। সে কারণে কর্মসূচিতেও জ্যেষ্ঠ নেতারা ঠিকভাবে নামেন না। ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে অবস্থান কর্মসূচিতেও অনেক নেতা নামেননি। এ বিষয়টিকেও ভালোভাবে নেননি তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তবে জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রতি হাইকমান্ডের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে বলে দাবি দলটির।
মন্তব্য করুন