‘প্রত্যয়’ স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন-কর্মবিরতি, এরপর শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার উত্তাল গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারেরই পতন। টানা এই আন্দোলন-সংগ্রামে দীর্ঘদিন কোনো ক্লাস হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। অবশেষে সাড়ে তিন মাস বন্ধ থাকার পর গতকাল রোববার থেকে শুরু হয়েছে ক্লাস-পরীক্ষা। নতুন বাংলাদেশে নতুন করে প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখা গেছে শ্রেণিকক্ষগুলোতে।
ক্লাস শুরুর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন চত্বরে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ এবং বিভিন্ন অনুষদের ডিন এই কর্মসূচিতে অংশ নেন। এ সময় শান্তির প্রতীক পায়রা ওড়ানো হয়।
এর আগে, ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি মিলিয়ে ২ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বন্ধ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। তবে এ সময়ে বিভিন্ন বিভাগে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১ জুলাই থেকে ক্লাস চালুর কথা থাকলেও ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা করে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে পড়ে। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন মাস (১১২ দিন) বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে ৭ জুলাই থেকে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেন। এর মধ্যে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন ঘটে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর হল ও অফিস কার্যক্রম শুরু হলেও ক্লাস শুরু করা যায়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল পদত্যাগ করেন। ২৭ আগস্ট নতুন উপাচার্য হন অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান। ১২ সেপ্টেম্বর জরুরি সিন্ডিকেট সভায় ক্লাস শুরুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
গতকাল আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের প্রথম বর্ষের ক্লাস ছাড়া অন্য সব বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে প্রথম বর্ষের ক্লাস বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্লাস শুরুর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বিভিন্ন অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের ক্লাসরুম পরিদর্শন করেন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। সৌহার্দ্য, হৃদ্যতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ক্লাস অনুষ্ঠিত হওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের আওতাভুক্ত বিভাগগুলোতে সুষ্ঠুভাবে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি এখন একটু কম। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, কয়েকটি বিভাগে শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি-দাওয়া ছিল, সেগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী মেনে নেওয়া হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পর ক্লাসে ফিরতে পেরে উচ্ছ্বসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সায়েম। তিনি বলেন, ‘করোনার সময় আমাদের দীর্ঘ একটা সময় বাড়িতে কাটাতে হয়েছে, তখন অ্যাকাডেমিক্যালি অনেক পিছিয়ে যাই। এরপর আবার শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে বিশাল গ্যাপ তৈরি হয়। আমরা মূলত মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। অবশেষে কয়েক মাস পর ক্লাস শুরু হলো। এটা আমাদের জন্য স্বস্তির ও ভালো লাগার। আজ ক্লাসে এসে মনে হচ্ছে ক্যাম্পাস যেন আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।’
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি মোহাম্মদপুর থাকি। মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পাসে আসতাম। তবে তখন কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব হতো। ঘরে বসে থাকতেও আর ভালো লাগত না। ক্লাসে ফেরার জন্য অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম। অবশেষে প্রাণের ক্যাম্পাসে সবাইকে পেয়ে ভালো লাগছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে ক্লাস শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, গণমাধ্যম কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। উপাচার্য বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছে। এই ট্রমা নিরসন এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চালু হয়নি অনেক বিভাগের শ্রেণি কার্যক্রম: এদিকে এখনো বেশ কয়েকটি বিভাগে শ্রেণি কার্যক্রম চালু করা যায়নি। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ (আংশিক বন্ধ), আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সেস অনুষদের ওশেনোগ্রাফি বিভাগ, কলা অনুষদের দর্শন বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটসহ আরও কিছু বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে শ্রেণি কার্যক্রম কিছুটা স্থবির আছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন শিক্ষকের পদত্যাগ চেয়ে ক্লাস পরীক্ষা বয়কট করেছেন শিক্ষার্থীরা। শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একাংশ বিভাগটির চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেছে। আরেক অংশ শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। ওশেনোগ্রাফি বিভাগেও কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতি ঘটায় ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। দর্শন বিভাগ এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের পরিচালকের অনুপস্থিতিতে স্থবির হয়ে আছে এর শিক্ষা কার্যক্রম। এসব কারণে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো চাপের মুখে পড়লেও তা দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।