সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়তে থাকায় বর্তমানে দেশ-বিদেশে দক্ষ গাড়িচালকের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দক্ষ চালকদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এবং দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে ২০২০ সালে একটি প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিয়েছিল জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)। সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ চালক গড়ে তোলার লক্ষ্যে নেওয়া ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি শেষ করার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
সেই হিসাবে প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে আর মাত্র দেড় মাস। অথচ নির্ধারিত মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গেলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক চালককেও প্রশিক্ষণ দিতে পারেনি সংস্থাটি। তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় লক্ষাধিক চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪০ শতাংশেরও কম চালককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বিএমইটি। অর্থাৎ ৪০ শতাংশেরও কম চালককে প্রশিক্ষণ দিতেই প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় এখন অন্যদের প্রশিক্ষণ দিতে আরও দুই বছর সময় বাড়াতে চায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি। এজন্য সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করে বিএমইটি। তবে সময় বাড়ালেও সেই সময়ের মধ্যে সবার প্রশিক্ষণ শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ পাঁচ বছরে যেখানে অর্ধেকের কম চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে দুই বছরে অন্যদের কীভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, এ নিয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেওয়া ‘দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ প্রদান’ শীর্ষক প্রকল্পে দেখা দিয়েছে এমন চিত্র। দক্ষ গাড়িচালক তৈরির উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আলোচ্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়। বাস্তবায়ন কাল ধরা হয় ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয় ২৬৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ ২ হাজার ৪০০ জন চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে ১১টি ব্যাচে মাত্র ৩৮ হাজার ৫৩৩ জনকে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেই হিসাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া বাকি রয়েছে আরও ৬৩ হাজার ৮৬৭ চালক। অর্থাৎ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও এখনো অর্ধেকের বেশি চালকের প্রশিক্ষণ বাকি রয়েছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মোট বরাদ্দের মাত্র ৪৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষ চালক হতে পারলে জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়তে থাকায় দেশেও দক্ষ চালকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে আসায় স্বাভাবিকভাবেই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাকিদের প্রশিক্ষণ দিতে আরও দুই বছর সময় চেয়ে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
বিএমইটির প্রকল্প সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর গত ১১ নভেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) মোস্তাফিজুর রহমান। ওই সভায় বর্ধিত মেয়াদেও প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া ব্যয় কমানোসহ বেশকিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত প্রকল্পে নতুন প্রকল্প এলাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতা প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্প এলাকা হিসেবে উপজেলা পর্যায়ে নতুন ৪০টি টিটিসি অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় সভায়। এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। দুই বছরে অবশিষ্ট কাজ শেষ করা সম্ভব হবে কি না বা কোন কৌশলে সম্ভব হবে, সে বিষয়েও সভায় জানতে চাওয়া হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি কেন এত কম, তা নিয়ে পিইসি সভায় আলোচনা করা হয়েছে। সাড়ে চার বছরেও লক্ষ্যমাত্রার ৪০ শতাংশ চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি প্রকল্পের আওতায়। সেখানে বাকি দুই বছরে কীভাবে ৬০ শতাংশ চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা প্রশ্নের মুখে পড়েন। এ ছাড়া বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর কথা বলা হয়েছে।
সভা সূত্রে জানা গেছে, প্রশিক্ষণ চলাকালীন জনবলের সংস্থান রাখা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ৪০টি টিটিসিতে বিদ্যমান জনবল থেকে ১ জন করে বদলির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যমান টিটিসিগুলোতে প্রশিক্ষক সংকট দেবে কি না, তা নিয়ে সভায় আলোচনা করা হয়েছে। নতুন ৪০ টিটিসিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করার প্রস্তাব করা হলেও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়নি।
এদিকে, আলোচ্য প্রকল্পের যানবাহন ও প্রশিক্ষণ গাড়ি (মেরামত ও সংরক্ষণ) অংশে প্রস্তাবিত ২ কোটি ৪ লাখ টাকা কমিয়ে ৭০ লাখ টাকা করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশে ১ কোটি ৭৩ লাখ ৪১ হাজার টাকা কমিয়ে ২৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, প্রশিক্ষণ ব্যয় ৪ কোটি টাকা কমিয়ে ৫৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য মনিহারি ১০ লাখ টাকা বাড়িয়ে ১৭ লাখ টাকা নির্ধারণের যৌক্তিকতা নিয়ে সভায় প্রশ্নের মুখে পড়েন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
সংশোধনীর বিষয়ে বিএমইটির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অন্যতম অনুসঙ্গ হলেও সরকারি বিধিনিষেধের কারণে প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গাড়ি কেনা সম্ভব হয়নি। গাড়ি ছাড়া তো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ কারণে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধনী প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ চালক তৈরি করা সম্ভব হবে।