মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ১১ ভাদ্র ১৪৩২
মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৪ জুন ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিপাকে জনতা ব্যাংক

অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিপাকে জনতা ব্যাংক

অনিয়মের মাধ্যমে ম্যানেজ ফর্মুলায় ইউসান নিট কম্পোজিট নামক একটি অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বারবার ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের দিলকুশা করপোরেট শাখা। এখন পর্যন্ত একটি ঋণও সময়মতো ফেরত দেয়নি। তার পরও বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে দেওয়া হয়েছে ঋণ পুনঃতপশিলের সুবিধা। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের এমন সুনজর পেয়ে আবারও নতুন ঋণ নিয়েছেন ইউসান নিটের উদ্যোক্তারা। ইক্যুইটি, দীর্ঘমেয়াদি দায় এবং চলতি দায় মিলিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে এখন আটকে আছে জনতা ব্যাংকের ১০৬ কোটি ৪৮ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

ঋণের অঙ্ক বড় হওয়ায় প্রতিবারই বিষয়টি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গেছে। প্রয়োজন হয়েছে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন; কিন্তু ইউসান নিটকে ঋণ দিতে আপত্তি করেনি কেউ। আগের পর্ষদের মেয়াদকালে এসব অনিয়ম হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বর্তমান কর্তৃপক্ষও। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পরিদর্শন প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট নথি বলছে, ২০১০ সালের ২০ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ১৯২তম সভায় ইউসান নিট কম্পোজিটের একটি প্রকল্পের অনুকূলে ৩৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়; কিন্তু যেসব কাগজপত্রের ভিত্তিতে এ ঋণ দেওয়া হয় তাতে প্রকল্পের লে-আউট প্ল্যান ছিল না। ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত কোথাও কেউ গুরুত্বপূর্ণ এ দলিলের বিষয়ে প্রশ্ন তোলেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন বলছে, গ্রাহকের সক্ষমতা যাচাই না করেই ইউসান নিটের ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ প্রস্তাব অনুযায়ী, অনুমোদিত মূলধন ২০ কোটি টাকার বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন মাত্র ২ কোটি টাকা দেখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এত কম মূলধনের প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শুধু গ্রাহকের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ঋণ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্রাহকের সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করা হয়নি।

শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে পেশাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জমির মূল্যায়ন করা হয়নি। বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদনে জমির মূল্য আড়াই কোটি টাকা হলেও ঋণ প্রস্তাবে জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা অতি মূল্যায়ন করে ৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে।

ইউসান নিট কম্পোজিটের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার ক্ষেত্রেও গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১৫ সালে ৪টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি এলসির সরবরাহকারী কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান মাদারীপুর স্পিনিং মিলস লিমিটেড। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ৯১টি লোকাল ব্যাক টু ব্যাক, ২০১৭ সালে ১৩০টি এবং ২০১৮ সালে ৬৮টি ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয়, যা ব্যাংকের শাখার ঋণ মঞ্জুরি ক্ষমতাবিধি নির্দেশনার লঙ্ঘন।

ফোর্সড ডিমান্ড লোন সৃষ্টিতেও গুরুতর অনিয়ম করেছে ব্যাংকটি। পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ইউসানের নামে ফোর্সড ডিমান্ড লোন সৃষ্টি করা হয়েছে। রপ্তানি এলসি বা চুক্তিপত্রের বিপরীতে খোলা ব্যাক টু ব্যাক এলসির দায় রপ্তানি আয় থেকে সমন্বয় করা হয়নি। ২০১৮ সালে ব্যাংকের ৫৪৫তম সভায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে বিলমূল্য পরিশোধে প্রয়োজনীয় তহবিল না থাকলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অনুমোদন নিয়ে গ্রাহকের হিসাবে ফোর্সড ডিমান্ড লোন সৃষ্টি করে রপ্তানিকারকের ব্যাংকে এলসি মূল্য পরিশোধ করার নির্দেশনা দিয়েছিল; কিন্তু সেই নির্দেশ লঙ্ঘন করে শাখা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইউসানের নামে ফোর্সড ডিমান্ড লোন সৃষ্টি করে ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিলমূল্য পরিশোধ করে।

এ ধরনের ডিমান্ড লোন সৃষ্টির আগে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের মালপত্র সরেজমিন পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও জনতা ব্যাংকের দিলকুশা করপোরেট শাখা তা করেনি। আমদানি পণ্যের সুষ্ঠু হেফাজত বা তদারকি না করেই ডিমান্ড লোন দেওয়া হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির আবেদনপত্রে দেওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই নোট উপস্থাপন করা হয়েছে, যা শাখা ব্যবস্থাপক (ডিজিএম) অনুমোদন করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণ পুনঃতপশিলীকরণেও বড় ধরনের অনিয়ম করেছে ব্যাংকটি। গ্রাহকের প্রকল্প ঋণের স্থিতি ৬৬.৩৪ কোটি টাকা এবং ডিমান্ড লোন আদায়ে দায়েরকৃত মামলায় উল্লিখিত স্থিতি ৩৩.৫২ কোটি টাকা পরিচালনা পর্ষদের সভায় পুনঃতপশিলের অনুমোদন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রকল্প ঋণ তৃতীয়বার পুনর্বিন্যাস প্রদান করার পরও প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণগুলো খতিয়ে দেখা হয়নি। পর্যদ ও প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে প্রকল্প ঋণ বিতরণে গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতিসাধনের পরও শাখা ব্যবস্থাপনাসহ প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরকে দায়ী করা হয়নি। শাখা ব্যবস্থাপনা কর্তৃক প্রধান কার্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে, ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে, স্বেচ্ছাচারিতা দেখিয়ে, ব্যাংকিং নিয়মাচার ও শুদ্ধাচার পরিপন্থিভাবে ওই গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা প্রদান করে ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপনের পরও তাদের দায়ী করে কোনোরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শাখা ব্যবস্থাপনা কর্তৃক একই ধারাবাহিকতায় ফোর্সড ডিমান্ত লোন সৃষ্টিতেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিধি মোতাবেক ডাউন পেমেন্ট আদায় করা হয়নি। পর্যাপ্ত সহজামানত গ্রহণ করা হয়নি। গ্রাহক কর্তৃক পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র প্রদান ব্যতীত প্রকল্পের পিসিআর ইস্যুকরণ করা হয়েছে। গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংক শাখায় দাখিলকৃত আর্থিক বিবরণী দুটি দাখিল করা হলেও এর যথার্থতা নিরূপণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে ইউসান নিট কম্পোজিটকে ঋণ দেওয়ার সার্বিক প্রক্রিয়া মূল্যায়ন করে বলা হয়, ‘প্রকল্প ঋণ বিতরণ, ব্যাক টু ব্যাক এলসি স্থাপন, ফোর্সড ডিমান্ড লোন সৃষ্টি এবং পুনঃতপশিলীকরণে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। একজন গ্রাহকের অনুকূলে যথাযথ যাচাই-বাছাই না করেই ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের নীতি নৈতিকতা, দক্ষতা, ব্যাংকের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখা, ব্যাংকিং নিয়মাচারসহ বাংলাদেশ ব্যাংক, বিনিয়োগ বোর্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা প্রতিপালন সব কিছুই এতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।’

ইউসান নিট কম্পোজিটের ঋণে অনিয়ম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল জব্বার বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে এখনো জানি না। তবে ধারণা করছি, নিশ্চয়ই ভালো প্রতিষ্ঠান বলেই তাদের ঋণ দেওয়া হয়েছিল।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউসান নিট কম্পোজিট এখন আর সচল নেই। নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত কারখানায় নেই উৎপাদন। অবকাঠামো ভাড়া দেওয়া হয়েছে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে। ফলে জনতা ব্যাংকের পাওনা ফেরত নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ফরহাদ ইউসান বলেন, ‘আমরা আসলে ৩৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলাম, যা সুদে-আসলে চারগুণ হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ঋণ নেওয়ার পরপরই সরকার গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। গ্যাস ছাড়া তো ডায়িং ফ্যাক্টরি চালানো একেবারেই সম্ভব না। এ কারণে গত সাত বছর আমরা উৎপাদনে যেতে পারিনি। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ঋণের কিস্তিগুলো সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সুদ-আসলে সেই ঋণ আজ শতকোটিতে পরিণত হয়েছে। তাই এখন বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে সেই দায়দেনা পরিশোধের চিন্তা করা হচ্ছে।’

অবশ্য বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির জন্য যে দাম উঠছে, তা দিয়েও ব্যাংকের দায় পুরোপুরি পরিশোধ সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া এবং তা আদায় করতে না পারার বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘সঠিক যাচাই-বাছাই না করে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে বলেই এমন ঘটনা ঘটছে। জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তি না দিলে এমন পরিস্থিতি চলতেই থাকবে ।’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করলেই নানা ধরনের অনিয়ম ও জালিয়াতি করে। ফখরুদ্দিন আহমেদ যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আমানতের ৫ শতাংশের বেশি ঋণ বিতরণ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এখনো সে রকম নীতিমালা জারি করা না হলে তাদের সংযত রাখা যাবে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকা শিশু হাসপাতাল শাখা ড্যাবের নতুন দায়িত্বে ডা. ফারুক

এনসিপির আরও চার নেতার পদত্যাগ 

হাইকোর্টের বিচারপতি হলেন সারজিসের শ্বশুর লুৎফর রহমান

ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণার বিধিমালা প্রকাশ

হাসনাতকে ‌‘ফকিন্নির বাচ্চা’ বললেন রুমিন ফারহানা

বিজিবির কাছে ৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ

চুরির অভিযোগ, গণপিটুনিতে যুবক নিহত

সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি : ড. কামাল হোসেন

রাকসু নির্বাচনে ভোটাধিকারের দাবিতে নবীন শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

চট্টগ্রামের মিষ্টি কারখানায় স্বাস্থ্যঝুঁকি, মধুবন ফুডকে জরিমানা

১০

আশুলিয়ায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

১১

জাবির সাবেক সহকারী প্রক্টর জনি রিমান্ডে

১২

প্রাণনাশের শঙ্কায় ভুগছেন ফজলুর রহমান, চাইলেন নিরাপত্তা

১৩

বাংলাদেশ সফর নিয়ে ইসহাক দারের প্রতিক্রিয়া

১৪

অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে চিকিৎসার মান কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছায়নি : ডা. রফিক 

১৫

মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানো থালাপতির উত্থানের গল্প

১৬

চট্টগ্রামের নগরায়ণ সংকটে শহরবাসী, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন নেই

১৭

মুন্সীগঞ্জে পুলিশ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলা, ব্যাপক গোলাগুলি

১৮

ইসরায়েলে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা কতটুকু?

১৯

আন্দোলনের সময় ছাত্রদের নগ্ন ভিডিও করতেন তৌহিদ আফ্রিদি : আইনজীবী

২০
X