ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ ও বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই পর্যবেক্ষণের আলোকে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। আলোচিত এই হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত সব আসামিকে খালাস দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে এমন মতামত এসেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা এই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করে গত ১ ডিসেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স খারিজ করে এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল মঞ্জুর করে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, ‘শুধু অনুমানের ভিত্তিতে এ মামলার রায় দেওয়া হয়েছিল। কোনো আইনি ও যুক্তিযুক্ত প্রমাণের পাশাপাশি আইনি ভিত্তির অনুপস্থিতি থাকায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা এ দেশের ইতিহাসের এক জঘন্য মর্মান্তিক ঘটনা। যেখানে আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বিদেহীদের আত্মার শান্তি ও ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য এই হত্যাকাণ্ডের সঠিকভাবে, স্বাধীনভাবে তদন্ত হওয়া দরকার, যা এই ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে একটি সঠিক এবং বিশেষজ্ঞ তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তদন্ত করার স্বার্থে মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো উচিত।’
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। সে ঘটনার তদন্তকে ভিন্ন খাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নানা তৎপরতা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) নতুনভাবে তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। পরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামলার অধিকতর তদন্ত হয়। এরপর তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় করা মামলায় (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
রায়ের পর ২০১৮ সালে বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলা দুটির নথিপত্র হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। এটি সংশ্লিষ্ট শাখায় ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। আইনজীবীরা বলেন, কোনো ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। এটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের জেল আপিল, নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। ডেথ রেফারেন্স এবং এসব আপিল ও আবেদনের ওপর সাধারণত একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে। এ মামলার ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের ওপর হাইকোর্টে গত ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর গত ১ ডিসেম্বর সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট।
অধস্তন আদালতে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ডবিধি ৩০২, ১২০খ, ৩৪ ধারায় হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই ১৯ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. হানিফ, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক আবদুর রহিম, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, পিন্টুর ভাই হরকাতুল জিহাদ নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মাদ, শেখ আব্দুস সালাম, কাশ্মীরি নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাট, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মুফতি হান্নানের ভাই মুহিবুল্লাহ মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাইদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইনুদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, মো. রফিকুল ইসলাম সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
এ মামলায় অধস্তন আদালত থেকে ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। তারা হলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, বিএনপির সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, হরকাতুল জিহাদ নেতা আব্দুল হান্নান ওরফে সাব্বির, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে পীর সাহেব, মো. খলিল, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, বাবু ওরফে রাতুল বাবু, শাহাদত উল্যাহ ওরফে জুয়েল, আরিফ হাসান সুমন, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার ও লিটন ওরফে মাওলানা লিটন। এরা সবাই হাইকোর্টের রায়ে খালাস পেয়েছেন।
১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন অধস্তন আদালত। এর মধ্যে চার জনের ৩ বছরের জেল দেওয়া হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন-সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, মামলার প্রথম দিকের তদন্ত কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডির সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ। এ ছাড়া পাঁচ জনকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা ও আইজিপি শহিদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক এ টি এম আমিন আহমদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার। এ ছাড়া দুজনকে ২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রয়েছেন- পুলিশের সাবেক উপকমিশনার (পূর্ব) মো. ওবায়দুর রহমান এবং উপ কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাইদ হাসান। এই ১১ আসামিকেও খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।