ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ার পর জাতীয় পার্টির (জাপা) রাজনীতি জুলাই বিপ্লবের পর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন দলীয় কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর হয়েছে। দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে গত নভেম্বরে মিছিল সমাবেশ করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেও ছাত্র-জনতার কঠোর বাধার মুখে পড়ে তা পণ্ড হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয়, আঞ্চলিক ও জেলা উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দায়ের হওয়া মামলায় আসামি হয়েছেন। অনেকে আত্মগোপন করেছেন। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
এ অবস্থায় দল গোছানো ও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা করেছেন। সেখানে তিনি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দাবি করে বলেছেন, ‘নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের সংস্কার প্রয়োজন নেই। নির্বাচনের পর যারা সরকার গঠন করবে তারাই সংস্কার করবে। এই সরকার বৈষম্য করছে। স্থিতিশীলতা চাইলে সবাইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দোষী অভিযোগ করলেই কেউ দোষী হয় না। সব দলকেই জনগণের সামনে রাজনীতি করতে দেওয়া উচিত।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জাতীয় পার্টি সরকারের কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। একতরফা নির্বাচনে তারা অংশ নিয়ে বিনা ভোটের নির্বাচনগুলোয় বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। তারা মন্ত্রিত্ব নিয়েছে। অতএব তারা সহজেই রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে না। তাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া দিনে দিনে দলটির জনপ্রিয়তাও তলানিতে ঠেকেছে। কমেছে জনসমর্থন। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য দলটির নেতাকর্মীরা জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত; কিন্তু তা না করে তারা যদি ফের আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে কথা বলে, সেটা তাদের জন্যই বুমেরাং হবে।’
জানা গেছে, মাঠের রাজনীতির সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দলীয় প্রধানের নামে বিবৃতি, জেলাভিত্তিক নেতৃবৃন্দ ও বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক ছাড়া প্রায় বন্ধ রয়েছে দলটির যাবতীয় কর্মকাণ্ড। সবমিলিয়ে এক ধরনের অসহায় অবস্থায় রয়েছে জাতীয় পার্টি। আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ সম্ভব হবে কি না, সেই পরিস্থিতি থাকবে কি না, সে বিষয়ও তাদের ভাবাচ্ছে। দলের কর্মসূচি বিস্তৃত করার দাবি তৃণমূলের পক্ষ থেকে জানানো হলেও নিরাপত্তাঝুঁকির কারণে কেন্দ্রীয় নেতারা সে পথে হাঁটছেন না।
বিগত কয়েক দশকের ভোটের সমীকরণে জাতীয় পার্টি নানান কৌশলে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় সব সরকারের থেকে সুবিধা আদায় করেছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতপার্থক্য ও পারিবারিক বিরোধের কারণে দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জীবদ্দশায় কয়েক দফা ভাঙনের মুখে পড়ে দলটি। দলের বর্তমান যে বেকায়দায় রয়েছে, তা দূর করে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় পার্টি গঠনের দাবি তৃণমূলের; কিন্তু সংগঠনটির কেন্দ্র থেকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা।
গত নভেম্বরে কর্মসূচি দিয়ে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করে জাতীয় পার্টি; কিন্তু গত ১ নভেম্বর রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র, শ্রমিক ও জনতা’র ব্যানারে একদল লোক মিছিল নিয়ে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে যান। সেখানে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। কার্যালয়ে আগুন ও আসবাবসহ অন্যান্য সামগ্রী ভাঙচুর করা হয়। কার্যালয়ের দেয়ালে থাকা জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ম্যুরাল তুলে ফেলা হয়।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনায় ডাক পায় জাতীয় পার্টি; কিন্তু বিভিন্ন মহলের আপত্তির মুখে তারা আলোচনায় যেতে পারেনি। একপর্যায়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় বৈষমীবিরোধী ছাত্র-জনতা ও জাতীয় পার্টি। উত্তেজনা রাজধানী থেকে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলেও। গত বছরের নভেম্বরের প্রথম দিন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবসহ দলের নেতাদের নামে মামলা প্রত্যাহার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে ঢাকায় সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয়। ওইদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সভা-সমাবেশ বন্ধের নির্দেশনা জারি করে। মূলত এরপর থেকেই জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে অচলাবস্থার তৈরি হয়, কর্মকাণ্ড বিবৃতিনির্ভর এবং কার্যালয়ের কক্ষবন্দি হয়ে পড়ে।
জাতীয় পার্টি যে দেশের রাজনীতিতে কোণঠাসা তার প্রমাণ মেলে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বক্তব্যে। সপ্তাহ দুয়েক আগে এক বৈঠকে জিএম কাদের বলেন, সরকার জাতীয় পার্টিকে রাজনীতিতে কোণঠাসা করতে চাইছে। জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈষম্য শুরু হয়েছে। আমাদের স্বাভাবিক রাজনীতিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, আমাদের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হচ্ছে। সে হিসেবে আমরা নব্য ফ্যাসিবাদের শিকার মনে হচ্ছে।
দলের নীতিনির্ধারকরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর হিসেবে অস্বীকার করলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভিন্নমত দিয়েছেন। তাদের দাবি, গত তিনটি নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ ভোটে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ছিল। প্রতিটি সরকারের সময় হয় জাতীয় পার্টি সরকারের, নয়তো ‘পুতুল বা গৃহপালিত’ বিরোধী দলের ভূমিকায় ছিল। তৎকালীন সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে জাতীয় পার্টিকে নিজেদের পক্ষে রাখে। এজন্য জাতীয় পার্টি অস্বীকার করলেও, এ নিয়ম দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে জাতীয় পার্টিকেও দায় নিতেই হবে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতার পালাবদলের ফেরে জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার পর থেকেই দলের নেতাকর্মীরা ঝিমিয়ে পড়েছেন, দলের কর্মকাণ্ড হয়েছে স্থবির। শুরুতে দলীয় কার্যালয়ের বাইরে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও গত মাস দুয়েক মাঠে কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, আগামীর রাজনীতিতে দলটির ভূমিকা কী হবে—এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে আলোচনা থাকলেও দলের শীর্ষ নেতা অনেকেই দলীয় কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলছেন। প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না তাদের অনেককেই, নিজেদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখছেন।
তবে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা কর্মসূচির বিষয়ে চাপ দিলেও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রয়েছেন দ্বিধাবিভক্ত। গত নভেম্বর মাসে সৃষ্ট পরিস্থিতি আমলে নিয়ে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীসহ কয়েকটি দল আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাবনিকাশ করছে। জাতীয় পার্টি আগামী নির্বাচনে অংশ নিবে কি না বা বিগত সরকারের দোসর হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। দলীয় কর্মকাণ্ড ঝিমিয়ে পড়লে আবারও নানান কায়দায় দলকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনটি। এক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও আমলে নেওয়া হচ্ছে। সরকার পতনের পর সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের নামে অর্ধশতাধিক মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। নতুন করে কর্মসূচির ঘোষণার পর যদি হয়রানি বেড়ে যায়, সে আশঙ্কাও রয়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। এজন্য, মাঝে মাঝে দলের কার্যালয়ে হচ্ছে জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক। ভাষা দিবসকে ঘিরে সারা দেশের নেতাকর্মীকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ও শ্রমিক প্রতিনিধি সম্মেলন।
এ প্রসঙ্গে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী কালবেলাকে বলেন, যেহেতু বর্তমান সরকার চালকের আসনে রয়েছে, অনেক কিছুই তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে সবার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের জন্য যত বেশি দলকে নির্বাচনে টানতে পারবে, ততই সুবিধা। কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে সেই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন সম্ভব হবে না। এমনকি তাদের ভোটারদের ভোটে আনা যাবে না। বরং সেই দলের ভোটাররা নতুনভাবে সংগঠিত হবে, নতুন কিছু করবে—তবে কিছু সময় লাগবে, এটাই বাস্তবতা।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৮৯ আসনে প্রার্থী দিলে জয় পায় মাত্র ১১টিতে। ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা আসন পেয়েছিল ২৩টি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছে ২৭টি। জাতীয় পার্টি দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের গঠনের পর কয়েকটি মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল।
খণ্ডিত অংশেও নেই সুখবর
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠাতা এরশাদের জীবদ্দশা ও মৃত্যুর পর সব মিলিয়ে ছয়বার ভাঙনের শিকার হয়েছে দলটি। মূল দল থেকে বের হয়ে দল গঠন করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (জেপি), নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি), এম এ মতিনের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এরশাদের সহচর কাজী জাফরের জাতীয় পার্টি, প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদ ও সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের জাতীয় পার্টির নিবন্ধন নেই। সর্বশেষ ভাঙনের মুখে দল থেকে চলে যাওয়া অনেক নেতাকেই দলে ফেরানোর গুঞ্জন উঠলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের কালবেলাকে বলেন, দল কিছুটা বেকায়দায় রয়েছে যেমন সত্য, একই সঙ্গে একটি পক্ষ জাতীয় পার্টিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে। যারা দেশ চালাচ্ছে তারা সে কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছে না বরং বিরোধী মত দমন করছে। জনগণের জন্য জাতীয় পার্টি কাজ করেছে, এখন সেই জনগণের ওপর অন্যায়ের কথাগুলোও আমরা বলছি। আর এই জনমতকে ব্যবহার করে দলকে চাঙ্গা করার কাজ করছি। নেতাকর্মীদের নিরাপত্তাঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করছি। শিগগির দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক, একুশে ফেব্রুয়ারি, শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে দলীয় কার্যক্রম বেগবান করা হবে। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে খণ্ডিত অংশগুলোকে এক পতাকাতলে আনার কোনো উদ্যোগ নেই, তবে যদি কেউ দলে ফিরতে চায় সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।