কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আলেপের অপকর্মের কোনো শেষ নেই

অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গুমের অভিযোগ
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রখর মেধাবী এ তরুণ জড়িত ছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গেও। পড়াশোনার পাট চোকানো হলে বাদ দেন রাজনীতি। যোগ দেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। বিয়ে করেন বেসরকারি স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করা এক তরুণীকে। মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরিতে পরিবার নিয়ে ভালোই কাটছিল দিন। কিন্তু ২০১৫ সালের একটি ঘটনা লন্ডভন্ড করে দেয় তার জীবন। সাজানো-গোছানো সুখের সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় নিজে গুম থাকেন। জের টানতে হয় প্রিয়তম স্ত্রীকেও। তিন দিন র‌্যাব হেফাজতে রাখা হয় তাকে। এরপর স্বামীর মুক্তি ত্বরান্বিত হবে—এমন কথা বলে বারবার ধর্ষণ করা হয় স্ত্রীকে। পবিত্র রমজান মাসে শবেকদরের দিনে রোজা ভাঙিয়ে ধর্ষণ করা হয় স্ত্রীকে।

শুধু ওই একজন তরুণ কিংবা তার স্ত্রীই নন, বাংলাদেশ পুলিশের বরখাস্ত হওয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং র‌্যাবের সাবেক কোম্পানি কমান্ডার আলেপ উদ্দিনের লালসার শিকার হয়েছেন এমন অনেকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তত অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যাদের তুচ্ছ কারণে গুম করা হয়েছিল। এরপর নানা বাহানায় বছরের পর বছর নির্যাতন করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় পারিবারিক বন্ধন। ব্যবসা-চাকরি হারিয়ে এসব মানুষ আজও দিশেহারা। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি কেউই।

২০১৫ সালের ৩০ মে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থীকে। সেদিন বেলা ১১টার দিকে বনশ্রীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশে বের হওয়ার প্রাক্কালে তাকে আটক করা হয়। যদিও এর আগে তাকে তার অফিসে খোঁজ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল। সেখানে তাকে না পেয়ে অফিসের অন্য এক কর্মচারীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়।

ওই তরুণ বলেন, ধরার পরপরই আমাকে টর্চার করা হয়, যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারে যে আমি ভুল ব্যক্তি। মূলত তারা যাদের খুঁজছিলেন, তাদের কাউকেই আমি চিনতাম না। তাদের উপলব্ধির পর তারা আমার ওপর নির্যাতন বন্ধ করে। তবে আমাকে আট দিন ঘুমাতে দেয়নি। প্রথম দিনে প্রায় এক ঘণ্টা টর্চার করে এবং পরে রিমান্ড চলাকালীনও নির্যাতন চলে। তিনি বলেন, মোট ২৩-২৪ দিনের মতো রিমান্ডে ছিলাম, যা বিভিন্ন মামলায় ৫ থেকে ৭ দিন করে বিভক্ত ছিল। এরপর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির সময় আমাকে একটি প্রস্তুতকৃত স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে মামলার বর্ণনা সাজানো ছিল। সেই স্ক্রিপ্টে উল্লেখ ছিল যে, আমাকে আমার বাবার বাসার গ্যারেজ থেকে আটক করা হয়েছে এবং আমাদের কেস পার্টনারদের মধ্যে ছয়-সাতজনকে ওই গ্যারেজ থেকে আটক করা হয়। কারও হাতে ছুরি, কারও হাতে বোমা—এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন আমরা একটি ব্যাংক ডাকাতির জন্য বের হয়েছি। তবে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গিয়ে সত্যটাই বলি। শেষ পর্যন্ত মোট পাঁচটি মামলা হলো, যার ভিত্তিতে আমি ২৩ মাস জেল খাটলাম। এই ২৩ মাসের মধ্যে ডিটেনশন সেলে আট দিন আমাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমি ব্যবসায় মনোনিবেশ করি। কারণ, আগের ঘটনাগুলোর কারণে চাকরি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবারও বিপদের মুখোমুখি হই। আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার ফোন দিয়ে জানায়, কালো গ্লাসওয়ালা মাইক্রোবাসে কিছু লোক আমাকে খুঁজতে এসেছে। আমি পালানোর সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু এর ফল হয় ভয়াবহ। র্যাব প্রথমে এক গাড়ি নিয়ে আসে, তারপর তিনটি গাড়ি নিয়ে আমার খোঁজে তল্লাশি চালায়। আমার শ্বশুরবাড়িতেও অভিযান চালানো হয়।

আমাকে না পেয়ে তারা আমার স্ত্রী ও শ্যালককে ধরে নিয়ে যায়। তিন দিন তারা র্যাব-১১ এর হেফাজতে ছিল। ওই সময় আমি নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তখন আমাকে বলা হয়, আমি ধরা দিলে আমার স্ত্রী এবং শ্যালককে ছেড়ে দেবে। তখন শর্ত দিই যে, আগে আমার স্ত্রী ও শ্যালককে মুক্তি দিতে হবে, তারপর আমি আত্মসমর্পণ করব। পরে আমার স্ত্রী এবং শ্যালককে ছেড়ে দেয়। এরপর আমি আমার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েই র্যাবের কার্যালয়ে আত্মসমর্পণ করি। আমাকে গ্রেপ্তার করার পর আমার ধারণা ছিল, তারা হয়তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেই ছেড়ে দেবে, কিন্তু আমি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় মামলা লিখে ফেলল, আমাকে আদালতে চালান করল, এবং জেলে পাঠাল।

আমার স্ত্রীকে তিন দিন ধরে আটক রাখা হয় র্যাব অফিসে। তাকে এমন একটি সেলে রাখা হয়েছিল, যেখানে টয়লেটের সাইডের দেয়াল ছিল না, শুধু সামনের দেয়াল ছিল। সেখানে সিসি ক্যামেরাও ছিল। সেই তিন দিনে তাকে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি, খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো, আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার, ‘জঙ্গির বউ’ ও ‘জঙ্গি মদদদাতা’ বলে গালাগাল করা হয়েছে।

তিন দিন পর স্ত্রী ছাড়া পেলেও এবার আমাকে গ্রেপ্তারের পর তিন মাস পরে জামিন দেওয়া হয়। জামিনের পরে ফের আলেপ উদ্দিন আমাকে স্ত্রীসহ তার অফিসে ডাকে। তার অফিসে যাই। সেখানে আলেপের চেম্বারে আমরা দুজন বসেছিলাম। সেই দিন আলেপ আমাকে কিছু নসিহত করে গেস্টরুমে পাঠিয়ে দিল এবং বলল, ‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত কথা আছে।’ ১৫-২০ মিনিট পর আমার স্ত্রী গেস্টরুমে এলো। আমি প্রথমবার লক্ষ করলাম, তার চেহারা বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া, চোখ ছলছল করছে, হাঁটতে পারছে না। মনে হলো, এমন কিছু তাকে বলা হয়েছে, যা তাকে ভীত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।

এরপর কয়েকদিন কেটে গেল, কিন্তু আমি লক্ষ করতে লাগলাম যে, আমার স্ত্রী ক্রমশ মনমরা হয়ে যাচ্ছে, অন্যমনস্ক থাকছে। সে আমার সামনে থেকেও নেই, কথাগুলো শুনছে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না। বেঁচে থেকেও মৃতের মতো, প্রাণহীন, নিস্তেজ।

এরপর স্ত্রীকে এভাবে মনমরা হয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাপ দিতে থাকলাম। একপর্যায়ে আমার স্ত্রী সব ঘটনা খুলে বলে। আমাকে ক্রসফায়ার এবং নির্যাতনের করা হবে—এমন ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে দুবার ধর্ষণ করা হয়েছে। শ্লীলতাহানিও করা হয়েছে।

প্রথমে ছোটখাটো ইঙ্গিতমূলক কথা বলত, যেমন—‘আপনি একা একা কেমন আছেন?’, ‘আপনার স্বামীকে সহজে বের করে আনার জন্য কি কিছু করা যায়?’, ‘আসুন, আমরা বসে কথা বলি।’ এ ধরনের কথাবার্তা দিয়ে সে মানসিক চাপে ফেলত। যখন আমি দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার হলাম, তখন আমরা আফতাবনগরে থাকতাম। গ্রেপ্তারের পর আমার স্ত্রী তার বাবার বাড়ি, পূর্ব গোড়ানে চলে যায়। আলেপ উদ্দিন তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলে, ‘আপনার বাসার ঠিকানা মামলায় দেওয়া আছে, তাই ইনভেস্টিগেশনের জন্য আপনাকে বাসায় আসতে হবে।’ এভাবে আমার স্ত্রীকে বাসায় ডেকে আনে। সেই দিনই প্রথমবার আলেপ শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। বাসার দারোয়ান তখন ছিল এবং আলেপ নিজেকে আমার খালাতো ভাই পরিচয় দিয়ে উপরে উঠে আসে। তবে আমার স্ত্রী দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে এবং আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোতে মানুষ থাকার কারণে সে সফল হয়নি। এরপর আলেপ বারবার ফোন করে বোঝাতে থাকে, ‘আমি চাই আপনার স্বামী সহজেই বেরিয়ে আসুক। আমি চাই না সে আর কোনো হয়রানির শিকার হোক। আপনার সঙ্গে কথা বললে সব সহজ হয়ে যাবে।’ এভাবে সে আমার স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে।

তিন মাস পর যখন আমি জামিনে মুক্তি পেলাম, তখন আবার আমাকে রিঅ্যারেস্ট করা হলো এবং থানায় নেওয়া হলো। এবার আলেপ পুরোপুরি পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। সে আমার স্ত্রীকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিল, ‘এখন সবকিছু আমার হাতে। চাইলে আমি তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিতে পারি, আবার চাইলে নতুন মামলায় ফাঁসাতে পারি এবং চাইলে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করতে পারি।’ এই চাপের মুখে নিরুপায় করে আলেপ আমার স্ত্রীকে তার অফিসে ডাকে। অফিসে দেখা করার পর সে তার ব্যক্তিগত সাদা টয়োটা গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যায়। মাঝপথে ইপিজেড পার হয়ে র্যাব অফিসার্স কোয়ার্টারে নিয়ে যায়। সেখানেই ঘটে সেই ভয়ংকর ঘটনা, যা আমার স্ত্রী অনেকদিন পর্যন্ত বলতে পারেনি। সেখানে সে আমার স্ত্রীকে প্রথমবার ধর্ষণ করে। ওই সময় আমার স্ত্রী আমাকে ঘটনা জানায়নি। ভেবেছে যদি আমি ভুল কিছু করে ফেলি। কিন্তু বের হয়ে আমি ঘটনা জানার পরে আলেপকে জিজ্ঞাসা করি। তখন সে উল্টো আমাদের ভয় দেখায়। মামলা, ক্রসফায়ারের ভয় দেখায়।

এরপর আমি জামিনে বের হই। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আলেপ আমার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করত। দেখা করতে চাইত। না করলে নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দিতে। তিনি বলেন, ওই সময়ে রোজার মাস ছিল। শবেকদরের দিন। আমি এতেকাফে বসেছিলাম মসজিদে। তখন আলেপ আমার স্ত্রীকে হুমকি দেয়। সামনের ঈদ মাটি করে দেবে। আমাকে মসজিদ থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেবে। এমন নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে স্ত্রীকে তুলে নেয়। এরপর ওই কোয়ার্টারেই নিয়ে যায়। প্রথমবার তিনতলার সাত নম্বর রুমে নেওয়া হয়েছিল। এর পরেরবার নিচতলায় ঢোকার সময় বাম পাশে। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী আমাকে সব ম্যাপ থেকে দেখাইছে। ইচ্ছে ছিল মামলা করব। কিন্তু স্ত্রী অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করায় আর মামলা করা হয়নি।

আমার স্ত্রী আর এই ট্রমা থেকে বের হতে পারেননি। দিনের পর দিন কেবল কান্না করতেন। রাতে মোনাজাতে দুই হাত উঠিয়ে কান্না করতেন। ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতেন। মানুষটা আমাকে খুব ভালোবাসত। কি সুন্দর সংসার ছিল! সবসময় হাসিখুশি। বেশি চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। কিন্তু সব শেষ করে দিল। বড় বড় মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু উন্নতি হয়নি। তিনি বলেন, যখন আমার স্ত্রী হাসপাতালে। কথা বলতে পারতেন না। তখনো চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদতেন। যেন ক্ষমা করে দিই। ঘটনার পর থেকে কখনো আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। শুধু আমার কাছে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন।

আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক অভিযোগের প্রায় সব অভিযোগেই রয়েছে এমন নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা। কোথাও কোথাও বিকৃত কথাবার্তা বলে মানসিক পীড়নের অভিযোগও পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। নির্যাতনের শিকার অনেক ব্যক্তিই বলছেন, আলেপ বিকৃত রুচির মানুষ। সবসময় নারীদের নিয়ে নোংরা কথা বলতেন। ভুক্তভোগীদের পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়েও নানা কুরুচিপূর্ণ কথা বলতেন।

ঢাকার তেজগাঁও এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয় বহুজাতিক একটি কোম্পানির কর্মচারীকে। নিজের ওপর হওয়া নির্মম নির্যাতনের বিচার দাবি করে তিনিও ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি স্বল্প বেতনে চাকরি করতাম একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে। কিন্তু সেখান থেকে আমাকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে আলেপ উদ্দিন। দিনের পর দিন একটা বদ্ধ ঘরে উলঙ্গ করে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। টানা দুদিনে একটু পানি পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, মারধর করার সময় আলেপ পাগলের মতো হয়ে যেতেন। একনাগারে দীর্ঘসময় ধরে পেটাতেন। আমাকে দুই হাত উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতেন। পায়ের পাতায় ক্রমাগত পেটাতেন। দাঁড়াতে পারতাম না। রক্ত বের হতো পাতা দিয়ে। এরপর ফের আবার মাথা নিচু এবং পা উপরে দড়ি দিয়ে বাঁধতেন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘসময় পেটাতেন। মুখ-নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে যেত। কিন্তু আলেপ থামতেন না।

তিনি বলেন, যা বেতন পেতাম তা দিয়ে কষ্ট হলেও ভালোই কাটত দিন। স্ত্রী এবং দুই সন্তান। কিন্তু আমি বের হওয়ার পরে দেখি স্ত্রী অসুস্থ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক নেই। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। রাতে ঘুমাতে পারেন না। কোনো কাজও করতে পারেন না। এভাবে অনিয়ম করতে করতে মাথার সব চুল পড়ে গেছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মানসিক ডাক্তার দেখিয়েও কোনো উন্নতি হয়নি।

আরও একজন ভুক্তভোগীকে তুলে নেওয়া হয়েছিল রামপুরা থেকে। পারিবারিকভাবে তারা কখনো বিএনপি কিংবা জামায়াত বা অন্য কোনো ইসলামী দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। এরপরও সন্দেহের বশে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আটক করা হয় জঙ্গিসহ মামলায়। জেলেই কেটে যায় সাত বছর। তিনি বলেন, দিনের পর দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। দুই হাত এবং দুই পায়ের সব আঙুল ভেঙে ফেলা হয়েছিল। দিন-রাত ছোট্ট একটা রুমের মধ্যে রাখা হতো। প্রথমদিকে না বুঝতে পারলেও পরে বুঝতে পারি এটা র্যাবের অফিস ছিল।

তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আলেপ উদ্দিন পেটাতেন। কখনো কখনো তিনি পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন। আর আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে রক্ত বেয়ে পড়তে থাকত। এভাবে প্রথমদিকের তিন মাসের প্রায় প্রতিটা দিন নির্যাতন করত। কখনো কখনো জ্ঞান হারালে অপেক্ষা করতেন কখন জ্ঞান ফেরে। অমানুষের মত পেটাতেন।

তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই মানসিক যন্ত্রণায় রাখতেন। যেহেতু আমি গুম হিসেবে ছিলাম, তাই বাইরের কোনো কিছুই জানতাম না। পরিবারের সদস্যরা খোঁজ পেয়েছিল কি না, তা-ও বুঝতে পারিনি। তবে নির্যাতনের মধ্যেই আলেপ আমার স্ত্রী-বোন এবং মাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতেন। কখনো কখনো বলতেন, তোর স্ত্রীও কয়েকদিন ধরে এখানেই পাশের রুমে আছে। আমরা আনন্দ-ফুর্তি করছি। মাঝেমধ্যে বোন আর মাকে নিয়ে এমন নানা কথা বলতেন। তখন খুব ভয় কাজ করত। খুব করে চাইতাম আমি যেন মারা যাই। এ কারণে খুব করে পেটালেও ওর দিকে রুদ্রমূর্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কিছু বললে আমিও উল্টো বলতাম। চিৎকার করে অভিশাপ দিতাম। আমি চাইতাম, যেন আমাকে আরও বেশি পেটায়। আমি মারা যাই। নিজের মা-বোন আর স্ত্রীকে নিয়ে যা বলতেন, মানতে পারতাম না। যেহেতু আমি বাইরের কিছু জানি না। তাই আতঙ্ক আর ভয় ছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আলেপ উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ সবচেয়ে মারাত্মক। স্বামীকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে স্ত্রীকে ধর্ষণের তথ্য পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে। তিনি অসংখ্য মানুষকে গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। নিষ্ঠুরতম পন্থায় নির্যাতন করেছিল। ইলেকট্রিক শক দেওয়া, চোখ বেঁধে রাখা, উল্টো করে ঝুলিয়ে পেটানো সব তিনি করেছেন, বলেন তিনি। চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘সবচেয়ে মারাত্মক যেটা করেছিলেন, গুম করে স্বামীকে হত্যার ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে রোজার মাসে রোজা ভাঙিয়ে একাধিকবার ধর্ষণ করেছিলেন। এর তথ্য-প্রমাণাদি আমাদের কাছে এসেছে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

৪৫ রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বহালসহ ৮ দাবিতে আলটিমেটাম

বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতদের ‘সুখবর’ দিলেন নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা শিগগিরই, যেসব আসনে লড়তে পারেন শীর্ষ নেতারা

যে জেলার কোনো আসনেই প্রার্থী দেয়নি বিএনপি

সেই প্রিয়াঙ্কাতেই আস্থা বিএনপির

ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী ‘মায়ের ডাকের’ তুলি

কুমিল্লার ৯ আসনে যাদের পেল বিএনপি

সৌদিতে বসে সুখবর পেলেন বিএনপির যে নেতা

যেসব আসন ফাঁকা রেখেছে বিএনপি

নতুন-পুরাতন মিলিয়ে রাজশাহীর আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থী হলেন যারা

১০

চমক দিয়ে বরিশালের ১৬টি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা

১১

দিনাজপুর-৬ আসনে ধানের শীষ নিয়ে লড়বেন ডা. জাহিদ

১২

জোট-সঙ্গীদের জন্য যেসব আসন রাখল বিএনপি

১৩

কুড়িগ্রামের ৪ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেলেন যারা

১৪

জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ হলেন আশরাফুল

১৫

খুলনার ৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা

১৬

নারায়ণগঞ্জের ৪টি আসনে বিএনপির প্রার্থী যারা

১৭

রংপুরের ছয় আসনে বিএনপির প্রার্থী হলেন যারা

১৮

ফেনীতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হলেন যারা

১৯

চাঁদপুরের ৫ আসনে প্রার্থী হলেন যারা

২০
X