ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) আকস্মিক বৈঠকে এ আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে। কানাঘুষা চলছে, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়টি শিগগির জনগণের সামনে স্পষ্ট হবে। রাজনৈতিক দলগুলোও এ বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সংস্কার এবং নির্বাচন ইস্যুতে এমন বৈঠক আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।
বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন ‘ওয়ান টু ওয়ান’ বৈঠক করেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে অনেকটাই আকস্মিক এ বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমকে কোনো পক্ষ থেকেই ব্রিফ করা হয়নি।
এর আগে ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ‘সব প্রস্তুতি শেষ করা গেলে ২০২৬ সালের পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।’ লন্ডন বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বলেন, ‘সঠিক তারিখ নির্ধারণে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। নির্বাচন কমিশন শিগগির একটা তারিখ ঘোষণা করবে।’ এরপর রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচন কমিশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ অবশ্য নির্বাচন কমিশনকে সরকারের ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ারও পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দলের নেতাদের বিভিন্ন সভায় সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে জোরালো বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশনও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সংকেতের দিকে তাকিয়ে আছে। ১৫ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নিজ দপ্তরে সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হলে ইসি সরকারের ভাব বুঝতে পারবে। তখন নির্বাচনের তারিখের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এ বৈঠককে লন্ডন বৈঠকের পরবর্তী ফলোআপ বৈঠক হিসেবেই দেখা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো এটিকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ বৈঠকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ এবং সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকতে পারে। ফলে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আরও একধাপ অগ্রগতি আসতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, লন্ডন বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকের ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা আরও কেটে যাবে। বৈঠকে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম অথবা দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারির ১০ থেকে ১৫ তারিখের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবারকে নিয়েই জোর আলোচনা আছে। লন্ডন বৈঠকেও এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে আভাস দেওয়া হয়। কারণ, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রোজা শুরু হতে পারে। সে হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী, ১৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার এবং সীমানা পুনর্বিন্যাস নিয়ে জটিলতা সম্পর্কেও আলোচনা হতে পারে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির বৈঠকের বিষয়গুলো জনগণের সামনে স্পষ্ট করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বিএনপির ধারণা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসি। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তুতি সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নেওয়া সম্ভব। উভয় পক্ষ থেকে বার্তা এলে সেটি স্পষ্ট হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে সব দলই একমত। যদি তাই হয়, তবে এই ঘোষিত সময়ের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন করা অসম্ভব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নানা আলোচনা ও গুঞ্জনের পর জাতীয় নির্বাচন বিষয়ে বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। লন্ডন বৈঠকের পর যমুনার বৈঠক তারই প্রমাণ। বৈঠকে সাবেক দুই সিইসির গ্রেপ্তারে কমিশনের উদ্বেগের বিষয়টিও উঠে আসতে পারে। এ ধরনের বৈঠক চলমান রাখার পরামর্শও দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের অবস্থানে যার যার মতো ছাড় দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে যাচ্ছে। এটি রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ।
জানতে চাইলে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, হয়তো সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন বা সংস্কারের ব্যাপারেও আলাপ হতে পারে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। অনেকগুলো আইনে পরিণত করতে হবে। তাদের বলা দরকার, ইসি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে স্বাধীন। তারা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নয়।
ইসি সূত্র জানায়, ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হলে তার আগে নিয়ম অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির শুরুতেই তপশিল ঘোষণা করতে হবে। সার্বিক প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে কমিশন। সেক্ষেত্রে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনী সামগ্রীর কেনাকাটা শেষ করতে চায় বলে কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন