ঢাকার পাশাপাশি বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। এ ছাড়া সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিদ্যমান বিধান সংশোধনের বিষয়ে দলগুলো সম্মতি জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের নবম দিনের আলোচনার শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফকালে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এসব কথা বলেন। এ সময় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। গতকালের আলোচনায় বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ৭ জুলাই পুনরায় আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সংবিধানের ৭০নং অনুচ্ছেদ, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে আলোচনা নিষ্পত্তি হয়েছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় (গতকাল) রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কিত বিধান এবং বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিগত সময়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছে।
তিনি জানান, সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে যে ঐকমত্য হয়েছে তা হলো—‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত মানদণ্ড, নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণক্রমে ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করা হইবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সংবিধানের ৪৯নং অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে ঐকমত্য কমিশন হতে দেওয়া প্রস্তাবের আলোকে যে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। এতদিন ধরে এই ক্ষমতার যে অপব্যবহার হয়েছে তা বন্ধ হবে।
বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত বিষয়ে যে অগ্রগতি হয়েছে তা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকবে তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে যে সার্কিট বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন তার পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি কর্তৃক প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ থাকবে। অর্থাৎ হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ১০০নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তন হবে বলে জানান তিনি।
বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, উচ্চ এবং নিম্ন আদালতে ফ্যাসিস্টদের বহাল রেখে যতই আমরা স্বাধীন বিচারব্যবস্থা করি না কেনো, এর সুবিধাভোগী এরা (ফ্যাসিস্টরাই) হবে। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য, ফ্যাসিস্টমুক্ত হতে হবে উচ্চ এবং নিম্ন আদালত। তারপরে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে কার্যকর হবে।
তিনি বলেন, আমরা বিগত সময় দেখেছি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ বড় বড় অপরাধ করা আসামিদের ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে হত্যাযজ্ঞের একটা উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশে এটার মাধ্যমে আলোচনায় আসছে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে এভাবে অবারিত থাকা উচিত কি না। সেই সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একমত পোষণ করে, আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতা প্রয়োগের একটা বিধান আনা যায় কি না এবং আইনি একটা পরামর্শ সভা বা বোর্ড রাখা যায় কি না, এ ছাড়া এর সঙ্গে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা যায় কি না, কী পদ্ধতি অনুসরণ করেই ক্ষমা প্রদর্শনীর বিষয়টি করা যায়—এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছি, রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাটা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের জন্য হাইকোর্টে বেঞ্চগুলো বিভাগগুলোতে স্থাপনের বিষয়ে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, আমরা চাই বিচারিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছুক। সে জন্য হাইকোর্টের বেঞ্চগুলো বিভাগীয় শহরে স্থাপন হোক, এটা আমরা চাই। তবে সে ক্ষেত্রে আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে এ বিষয়ে তার অনুমতি বা পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। আমরা বলেছি, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে এটি করা যায়।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা এই সময়ে এসে সংবিধানে এমন কিছু পরিবর্তন করতে পারব না, যে পরিবর্তন পরবর্তী সময় টিকবে না। সেটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এখন যে পর্যায়ে আছি, এখানে জনগণ ও রাষ্ট্রের কাছে আমাদের দায় অনেক বেশি। আমরা এখানেই রাজনৈতিকভাবে মতামত দিচ্ছি না। দেশের জনগণ ও দেশের কল্যাণের জন্য সার্বিকভাবে মতামত দিচ্ছি। এখানে কোনোভাবেই রাজনৈতিক বিবেচনা থাকার কথা না।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর পরিবার বা ভুক্তভোগীর সম্মতি ছাড়া কাউকে ক্ষমা না করার নীতিতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে বলে জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, অতীতে রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তে চিহ্নিত অপরাধীদের ক্ষমা করার ঘটনা ঘটেছে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি ছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের আগে একটি সুপারিশ কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমার বিষয়ে পরামর্শ দেবে। তিনি আরও বলেন, আমরা আজ নতুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করেছি। যদি কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ, যেমন হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং দোষী ব্যক্তিকে দণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ভুক্তভোগী পরিবারের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রপতি বা কমিটি এককভাবে সেই সাজা মাফ করতে পারবেন না। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সম্মতি দিলে তবেই ক্ষমা বিবেচনায় আসবে। এতে ইনসাফ নিশ্চিত হবে।
বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রসারণে ঐকমত্য হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০ কোটি মানুষের দেশে সবাই ঢাকায় এসে বিচার পাওয়ার সুযোগ রাখে না। তাই বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন সময়ের দাবি। এর মাধ্যমে বিচার মানুষের আরও কাছাকাছি পৌঁছাবে। তিনি জানান, বিচারপতি ও দক্ষ আইনজীবীর ঘাটতির কথা এলেও প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, মেধাবী ব্যক্তিদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের প্রক্রিয়া ও বিচারব্যবস্থার সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। অতীতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার অপব্যবহার হয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদেরও ক্ষমা করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। এতে ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হয়েছে, বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা যেন আর নিরঙ্কুশ না থাকে; বরং একটি বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে তা প্রদর্শিত হয়—এ প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি।
আখতার হোসেন বলেন, ২০ কোটি মানুষের দেশে হাইকোর্ট এবং আপিল বিভাগ মিলিয়ে কয়েক লাখ মামলা বিচারাধীন। মাত্র ১০০ জন বিচারপতি দিয়ে এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, আমরা যে গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে এই সংস্কার উদ্যোগে এসেছি, সেই জনগণের আকাঙ্ক্ষা আমাদের ধারণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো ও কমিশনের একমত হওয়া সিদ্ধান্তগুলো যেন বাস্তবায়ন হয়, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মন্তব্য করুন