বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ২৩ আশ্বিন ১৪৩২
হাসান আজাদ
প্রকাশ : ২২ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২২ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিদ্যুৎ ভর্তুকির ৫০০০ কোটি টাকা আটকে আছে

ক্রয় চুক্তির অনুমোদন নেই ৯ কেন্দ্রের
বিদ্যুৎ ভর্তুকির ৫০০০ কোটি টাকা আটকে আছে

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) অনুমোদন না থাকায় ৯ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্ধারিত ৫০৫৬ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা আটকে দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এই টাকা ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়কার। এর আগে ট্যারিফ অনুমোদন ছাড়াই কেন্দ্রগুলোকে হাজার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। রামপাল, পায়রাসহ মোট নয়টি কেন্দ্রের পিপিএ অনুমোদন পাওয়া যায়নি। বছরের পর বছর ধরে এসব কেন্দ্র পিপিএ অনুমোদন ছাড়াই যাচ্ছেতাই মূল্যে সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আসছিল। সম্প্রতি অর্থ বিভাগ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ভর্তুকি দেওয়ার হিসাব মেলাতে গিয়ে পিপিএ অনুমোদন না করানোর বিষয়টি ধরা পড়ে। ফলে এসব কেন্দ্র থেকে ক্রয় করা বিদ্যুতের মূল্য নতুনভাবে পর্যালোচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, ট্যারিফ বা পিপিএ চূড়ান্ত করার পর বাধ্যতামূলকভাবে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অথচ এ নয়টি কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয়নি। শুধু বিদ্যুৎ বিভাগের সম্মতি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে (পিডিবি) পিপিএ অনুমোদন করে এতদিন ধরে বিদ্যুৎ ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল কোম্পানিগুলো। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির উদাহরণ। এসব কোম্পানির সভাপতি ছিলেন সাবেক বিদ্যুৎ সচিবরা। বড় ধরনের এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে তাদের বাড়িঘর ক্রোক করে রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণ আদায় করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ট্যারিফ রিভিউ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ ঘটনায় কারও দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘এটা বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি। এসব কোম্পানির বোর্ডের প্রধান ছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদ্যুৎ সচিব। ফলে তারা যেমন খুশি তেমন কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন আবার যা খুশি তাই করেছেন। বোর্ডের অন্য সদস্যরাও এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। অবৈধভাবে ট্যারিফ নির্ধারণ করে ব্যাপক লুটপাট করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দিয়ে এ বিষয় অনুসন্ধানপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে দায়ীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘গত ২১ মে অর্থ বিভাগ থেকে পিডিবির চেয়ারম্যানকে নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা তলব করা হয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘সম্প্রতি অর্থ বিভাগ কর্তৃক নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ট্যারিফ অনুমোদন না করে অর্থছাড় করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এখানে উল্লেখ্য, উপরোক্ত নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে আটটির পাওয়ার পারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (পিপিএ) স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের সম্মতি রয়েছে এবং একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে (বাংলাদেশ চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড-বিসিআরইসিএল) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মতি রয়েছে।’

গত ১৪ মে অর্থ বিভাগের একটি চিঠির জবাবে ২১ মে পিডিবি জানায়, পিডিবি নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে আটটির জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে পিপিএ সম্মতি পেয়েছে। এ ছাড়া বিসিআরইসিএলও উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সম্মতি পেয়েছে বলে জানা গেছে।

বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির অনুমোদন বা যথাযথ ট্যারিফ অ্যাপ্রুভাল না থাকার বিষয়ে গত ১৭ জুন এক চিঠিতে অর্থ বিভাগ জানায়, বিদ্যুৎ বিভাগকে ৩ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হলেও পিপিএ অনুমোদন না থাকায় ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত ৫০৫৬.৮৯ কোটি টাকা আটকে রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ খাতের কোনো প্রকল্প গ্রহণের পর প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রথমে বিদ্যুৎ বিভাগ পরে মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নিতে হয়। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) অবশ্যই ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোর ক্ষেত্রে সে নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩ হাজার ৪১৩ মেগাওয়াট। কেন্দ্রগুলো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মিত। ওই সময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন নসরুল হামিদ বিপু।

ট্যারিফ অনুমোদন না নেওয়া নয়টি কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট (পায়রা), বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ময়মনসিংহ ২১০ মেগাওয়াট, কড্ডা ৫২ দশমিক ১৯৪ মেগাওয়াট, রাউজান ২৫ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ও গাজীপুর ১০৫ মেগাওয়াট, বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের মিরসরাই ১৬৩ মেগাওয়াট ও কড্ডা ১৫০ মেগাওয়াট এবং বাংলাদেশ চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেডের সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্ক।

এরই মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট (পায়রা) বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পিপিএ অনুমোদন হয় ২০২৩ সালে ২৪ ডিসেম্বর। ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর অনুমোদন হয় বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের পিপিএ। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ময়মনসিংহ ২১০ মেগাওয়াট কেন্দ্রের ২০০৩ সালের ২৮ জানুয়ারি, কড্ডা কেন্দ্রের ২০১২ সালের ১৪ জুন, রাউজান কেন্দ্রের ২০১৩ সালের ১৮ জুন ও গাজীপুর কেন্দ্রের ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ পিপিএ অনুমোদন হয়। এ ছাড়া বি-আর পাওয়ারজেন লিমিটেডের মিরসরাই ১৬৩ মেগাওয়াট ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ও কড্ডা ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। নয়টির মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ চায়না রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেডের সিরাজগঞ্জ ৬৮ মেগাওয়াট সোলার পার্কের জন্য ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন নেওয়া হয়। তবে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৭ জুন বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া অর্থ বিভাগের অন্য এক চিঠিতে জানানো হয়েছে, পিপিএ যথাযথভাবে অনুমোদন না নেওয়ার কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত ৫ হাজার ৫৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ভর্তুকি আটকে রেখেছে। একই সঙ্গে অর্থ বিভাগ বিদ্যুৎ বিভাগকে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে ভর্তুকির টানা নিতে হলে চলতি মানের মধ্যে ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদে পিপিএ অনুমোদন করে নিতে হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানান, গত বছরের আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই নিরীক্ষায় বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এই কেন্দ্রগুলো সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন এবং সরকারের সঙ্গে যৌথ মালিকানাধীন হওয়ার কারণে পিপিএ অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ওই সময়কার প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি জানতেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আ.লীগের কর্মী-সমর্থকদের জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া করলেন হাদি

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে ভুল উদ্ধৃতি সংশোধনের আহ্বান টিআইবির

‘আবরারের স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে অনেকের গাত্রদাহ দেখেছি’

সৌন্দর্যবর্ধনে সাভার উপজেলা প্রশাসনের নানা উদ্যোগ

ছেলের দায়ের করা মামলায় বাবাসহ তিনজনের মৃত্যুদণ্ড

ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে কোরআন অবমাননা, সিএমপির জরুরি সতর্কবার্তা

জাতীয়করণ নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি তারেক রহমানের বার্তা

চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ

খেলা শেষ হতেই রেফারির ওপর হামলা

জোর করে পদত্যাগ করানো শিক্ষকদের জন্য সুখবর

১০

আদালতের ‘ন্যায়কুঞ্জে’ খাবার হোটেল, প্রধান বিচারপতির নির্দেশে উচ্ছেদ

১১

অ্যানথ্রাক্স ছড়াচ্ছে উত্তরাঞ্চলে, রংপুর-গাইবান্ধায় সরেজমিনে তদন্ত শুরু

১২

চীন থেকে যুদ্ধবিমান কেনা প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা / জানলে যে সব বলে দিতে হবে সেটা তো না

১৩

শেখ হাসিনা ও কামালের নির্বাচনী যোগ্যতা নিয়ে যা জানা গেল

১৪

ছাত্রদলকে সমর্থন জানিয়ে চাকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন দুই প্রার্থী

১৫

খুন করে আল্লাহর ভয়ে নামাজ পড়ে ক্ষমা চান হত্যাকারীরা

১৬

ইংলিশদের বিপক্ষে মারুফাদের লড়াই করে হার

১৭

পিআর নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ব : চরমোনাই পীর

১৮

ফুটবলকে বিদায় বললেন মেসির আরও এক সতীর্থ

১৯

প্রথমবারের মতো ইউনেস্কোর সভাপতি বাংলাদেশ

২০
X