বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে নানা ধরনের কটূক্তি প্রসঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছেন, ‘এসব মন্তব্যে অখুশি হওয়ার কিছু নেই। যারা এসব করছে, তাদের বয়স কম। তারা আমাদের সন্তানের বয়সী। তারা বড় হলে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবে। তখন নিজেরাই লজ্জিত হবে।’
ঢাকা সেনানিবাসে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে দেড় ঘণ্টাব্যাপী অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাসদস্যদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন সেনাপ্রধান। অনুষ্ঠানে সেনা সদরের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সব সেনা স্থাপনার কর্মকর্তারা ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। সেনা সদর সূত্রে জানা গেছে, প্রথম অংশে সেনাবাহিনী প্রধান অফিসারদের উদ্দেশে ৩৮ মিনিট বক্তব্য দেন। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা অফিসারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
প্রাথমিক বক্তব্যে সেনাপ্রধান নিরলসভাবে কাজ করে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য সেনাবাহিনীর সব সদস্যকে অভিনন্দন জানান। তিনি উল্লেখ করেন, এই ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের মানুষ সেনাবাহিনী এবং এর প্রত্যেক সদস্যের প্রতি সবসময়ই কৃতজ্ঞ থাকবে। দেশ এখন নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহযোগিতা করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।
এরই মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে এবং সরকার তা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে সেনাপ্রধান সব সেনা সদস্যকে আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।
সেনাপ্রধান বাহিনীর শৃঙ্খলা, সততা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো, সেনাবাহিনী ইস্যুতে নানা কটূক্তির জবাব এবং মাঠ পর্যায়ে কাজের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাসহ প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর ইউনিটি ও পেশাদারি আচরণের কারণে দেশে-বিদেশে যারা ডিসইনফরমেশন (অপতথ্য) ও মিসইনফরমেশন (ভুয়া তথ্য) ছড়াচ্ছে তাদের হীন উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি বলে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান উল্লেখ করেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন সেনাসদস্যদের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং বাহিনীর চেইন অব কমান্ড অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সংগঠন। মাঠে দায়িত্ব পালনের সময় পেশাদারিত্ব দেখাতে হবে। প্রতিশোধমূলক কোনো কাজে জড়ানো যাবে না।’
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘একজন সেনা কর্মকর্তাকে গড়ে তুলতে রাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করে। তাই কেউ যাতে অপরাধে জড়াতে না পারে, সে বিষয়ে আগেভাগেই খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে সেটি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।’
সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও এর সদস্যদের বিরুদ্ধে চলমান অপপ্রচারের বিষয়ে তিনি সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। সেনাপ্রধান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের বিভিন্ন স্বার্থ উদ্ধারের লক্ষ্যে এমন কাজ করছে। এসবের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পেশাদারি আচরণ করাই শ্রেয়। তবে এসব অপরাধ যথাযথভাবেই লিপিবদ্ধ থাকছে এবং উপযুক্ত সময়ে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
নাম উল্লেখ না করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘একজন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ তদন্তাধীন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর কোনো সদস্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না। আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ নিয়েও তদন্ত চলছে। নৈতিক স্খলনের বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। তবে মিডিয়া ট্রায়ালের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া হবে না, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাবাহিনী প্রধান আরও কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেন। সেগুলো হলো—সেনা প্রথা ও আইন অনুযায়ী সেনাসদস্যদের রাজনৈতিক বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকা। বেসামরিক কর্তব্য পালনের অংশ হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় কোনো জীবনহানি বা আহত হওয়ার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা। যানবাহন দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ। সেনাসদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতার বৃদ্ধি এবং এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। পরিবারের প্রতি অধিক যত্নশীল হওয়া এবং সন্তানদের যথাযথভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সহকারে গড়ে তোলা। বিশেষ করে সন্তানদের মধ্যে আচরণমূলক সমস্যা ও মাদকে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা।
মন্তব্য করুন