ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক আরও জোরদারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে একমত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গত এক দশকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের দৃশ্যমান অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুই শীর্ষ নেতা। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লিতে তার সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে দুদেশের মধ্যকার অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে জোর দেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সহায়তা চেয়েছেন।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দিল্লি সফরের প্রথম দিনেই মোদির সঙ্গে দেড় ঘণ্টাব্যাপী দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। বৈঠকের আগে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত আলোচনাও হয়েছে। আন্তরিক, খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নিশ্চিতে অবদান রাখায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন মোদি।
বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক্স অ্যাকাউন্টে বাংলায় লেখা টুইটে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। গত ৯ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি খুবই সন্তোষজনক। আমাদের আলোচনায় কানেক্টিভিটি, বাণিজ্যিক সংযুক্তি এবং আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
বৈঠকের পর রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বৈঠকে ‘আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা বারবার বলছি আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চাই। ভারতও একই কথা বলছে। এই জিনিসটা নষ্ট হলে উভয় দেশে তো বটেই, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতেই তার প্রভাব পড়বে। ভারতও এ বিষয়ে একমত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বলেও জানান মন্ত্রী। তবে তিনি বলেন, দুই শীর্ষ নেতার একান্ত আলোচনায় হয়েছে কি না, জানি না।
ড. মোমেন জানান, প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে দুদেশের মধ্যে কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি বিনিময় চুক্তির মেয়াদ ২০২৩ থেকে ২৫ পর্যন্ত বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনপিসিআইর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। ভারতের এনপিসিআই ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে নেটওয়ার্ক-টু-নেটওয়ার্ক সংযোগের মাধ্যমে রুপি-টাকায় পারস্পরিক লেনদেনের কাজ সহজ হবে। তিনি জানান, শেখ হাসিনা স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং তাকে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে নিমন্ত্রণের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষ ধন্যবাদ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জি-২০’র বৈঠকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। উভয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ এবং ভারতের বিদ্যমান গভীর সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং এই সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একমত হয়েছেন। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জিত সাফল্যের কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্যমান শান্তিপূর্ণ অবস্থা নিশ্চিতকরণে অবদান রাখার জন্য শেখ হাসিনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি উভয় দেশের মধ্যকার অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো অফিসিয়াল পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দ্রুত প্রত্যাবাসন বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেন।
মন্ত্রী আরও বলেন, ভারত আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। প্রধানমন্ত্রী ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে কানেক্টিভিটি তথা রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতে উভয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন।
এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান নরেন্দ্র মোদি। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ অংশ নেন। ভারতীয় প্রতিনিধিদলে ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রমুখ। বৈঠকের আগে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসাডর, অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন বঙ্গবন্ধুর নাতনি সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে একটি স্যুভেনিয়র তুলে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।
ঠিক এক বছরের ব্যবধানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে মুখোমুখি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। গত বছরের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছিলেন। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত দুই শীর্ষ নেতার এ বৈঠককে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দুই দেশ। আর জি-২০ সভাপতি ভারত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এ সফরকেও হাইলাইট করছে নানাভাবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দিল্লি বিমানবন্দরে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী মোদির বিশেষ আস্থাভাজন বলে পরিচিত রেল প্রতিমন্ত্রী ও গুজরাটের সুরাট থেকে নির্বাচিত এমপি দর্শনা বিক্রম জারদোশ এবং দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ডেস্কের যুগ্ম সচিব স্মিতা পন্থ।
মন্তব্য করুন