

জুলাই জাতীয় সনদ, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘বিপরীতমুখী’ অবস্থানের মধ্যেই উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ সভা ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ সোমবার বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে তার সভাপতিত্বে এ বৈঠক বসতে যাচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ‘অনৈক্য’ তৈরি হয়েছে, তা দূর করার পথ খুঁজতেই মূলত বিশেষ এ সভা ডাকা হয়েছে বলে সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রের ভাষ্য। বৈঠকে গণভোটের তারিখ নির্ধারণ ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) আবারও সংশোধন নিয়েনতুন কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সাধারণত নির্দিষ্ট আলোচ্যসূচি (এজেন্ডা) থাকে। এজেন্ডার ভিত্তিতে প্রত্যেক উপদেষ্টার দপ্তরে সিলগালা করা ব্রিফকেস পাঠানো হয়। যে ব্রিফকেসে বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য নতুন আইন, বিধিবিধান কিংবা অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়বস্তু থাকে। থাকে বৈঠকের এজেন্ডাও। এসব এজেন্ডার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-বিভাগ তাদের বিষয়গুলো সভায় উত্থাপন করে। পরিষদ সেসব বিষয় যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদন করে। কিন্তু আজকের বিশেষ সভায় নির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা নেই। এতে ধারণা করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে দলগুলোর মধ্যে যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্যের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমিরের বৈঠকও হয়েছে। সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় হয় ওই বৈঠক। আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন বলে জানা গেছে। পরিষদের পরিকল্পনা অনুযায়ীই যৌক্তিক সময়ে গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হবে। তবে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দিনই গণভোটের পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। এ নিয়ে সরকার যে বেকায়দায় পড়েছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য উপদেষ্টাদের মতামত নিয়ে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা করা হবে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি-জামায়াত ও এনসিপি মাঠে যত গরম অবস্থানেই থাকুক না কেন, তারা ভেতরে ভেতরে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারও এ কাজে দলগুলোকে সহায়তা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অনৈক্য ও অচলাবস্থা দূর না হলে সরকারই বেকায়দায় পড়বে। সুতরাং সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা করে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নিতে চায়। এজন্য সংস্কার-নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে বিভাজন নিয়ে সরকারও চিন্তিত। যদিও শেষমেশ দলগুলো এক ছাতার নিচে আসবে, সেটিও বিশ্বাস করেন সরকারের দায়িত্বশীলরা। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনও হবে বলেও তারা মনে করেন।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘যে যেটা বলুক, আমরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্থে জাতীয় নির্বাচন করব। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা বদ্ধপরিকর।’
গণভোট প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, গণভোট কবে হবে, সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা দ্রুতই সিদ্ধান্ত দেবেন। গণভোট নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যে তিনি এ তথ্য জানান।
গণভোট কবে হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা থাকব। আমরা সহায়তা করার জন্য থাকব। সিদ্ধান্ত এটা কোনো পার্টিকুলার কেউ নেবেন না, এটা আপনারা নিশ্চিত থাকেন। এই সিদ্ধান্ত প্রধান উপদেষ্টা নেবেন।… দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় সংক্রান্ত সুপারিশ জমা দেয়। তাতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজনের সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন গণভোট করার কথা বলা হয়েছে সেখানে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর দাবি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে হবে এবং তার আলোকে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি চায়, নির্বাচনের দিনই গণভোট করতে হবে। এর বাইরে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, যে জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছিল, তার বাইরে অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এটিকে প্রতারণাও বলেছে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
আজকের বিশেষ এ বৈঠকে আরপিও ফের সংশোধনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে। উপদেষ্টা পরিষদের গত বৃহস্পতিবারের সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, জাতীয় নির্বাচনে দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে অংশ নিলেও প্রার্থীদের নিজের দলের প্রতীকেই ভোট করতে হবে। তবে আইনে এমন সংশোধনী আনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপি ও সমমনা বেশ কয়েকটি দল। কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই নির্বাচন কমিশন (ইসি) এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে দলগুলো। তারা এ সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে টার্গেট করেই সরকার এমন সংশোধনী এনেছে বলে অভিযোগ তাদের।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘অতীতে বড় দলগুলোর সঙ্গে একাধিক ছোট দল জোট করে বড় দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিতেছে কিংবা ভালো ফল করেছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ না করেও জোটভুক্ত হয়ে ধানের শীষ, নৌকায় ভোট করে জিতে এসেছে অনেকে। এবার আরপিও সংশোধন হওয়ায় জোট করলেও প্রার্থীকে নিজের দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। এতে ছোট দলগুলো বিপদে পড়বে বলে তারা ধারণা করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে আরপিওর এ সংশোধন নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।’
আরপিও সংশোধনের দুদিন পর গত রোববার বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক করে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানিয়েছে। সিইসির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বিএনপির নির্বাচনবিষয়ক কমিটির সদস্য ইসির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ জাকারিয়াও উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাচন ভবনে সিইসির সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, ‘আরপিওর ২০ অনুচ্ছেদ-এ সংশোধন এনে জোট করলেও ভোট করতে হবে দলীয় প্রতীকে—এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এমন সংশোধনে অন্যান্য দলের মতো বিএনপিও হতবাক হয়েছে। বিএনপি এই সংশোধনের সঙ্গে একমত নয়। এই সংশোধনী বা পরিবর্তন বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সংশোধনী থেকে সরে এসে আরপিওর আগের বিধান বহাল রাখার অনুরোধ জানিয়ে আমরা সিইসির কাছে আনুষ্ঠানিক পত্র দিয়েছি।’
সিইসির কাছে চিঠি হস্তান্তরের পর তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে বিভিন্ন দল নিজেদের বিবেচনায় জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে এবং নিজেদের দলের বা জোটের অন্য কোনো দলের প্রতীক নিয়ে ভোট করেছে। এটা গণতান্ত্রিক অধিকার।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সংবাদ সম্মেলন আজ দুপুরে : অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আজ দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে। দুপুর ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের করবী হলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, এই সংবাদ সম্মেলনটি শুধু বৈধ নিরাপত্তা পাসধারী স্বীকৃত সাংবাদিকদের জন্য উন্মুক্ত। এই পাসধারী সাংবাদিকদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
মন্তব্য করুন