মঙ্গলবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত আ.লীগ, গ্রিন সিগন্যাল ছিল হাসিনার, সমন্বয়ক তাপস

জানিয়েছে তদন্ত কমিশন
বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জড়িত আ.লীগ, গ্রিন সিগন্যাল ছিল হাসিনার, সমন্বয়ক তাপস

পিলখানা হত্যাকাণ্ডে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জড়িত থাকার এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ থাকার পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে এ বিষয়ক জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। গতকাল রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন কমিশনের সদস্যরা। প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর কমিশনের পক্ষ থেকে গতকাল সন্ধ্যায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্তের প্রধান দিকগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট, পরিকল্পনা, সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল। দেশকে অস্থিতিশীল করা, শেখ হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা এবং সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে দুর্বল করতেই এই বিদ্রোহ ঘটানো হয়।

তিনি বলেন, আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে বিদ্রোহের সঙ্গে কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজনের নাম তদন্তে উঠে এসেছে। তারা হলেন—সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, মীর্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাহারা খাতুন, নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারেক, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ, সাবেক ডিজিএফআই প্রধান জেনারেল আকবর।

বিদ্রোহের মূল কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। ডাল-ভাত কর্মসূচি, বিডিআর শপ তৈরি করা হয়েছিল। যার কারণে ডিউটি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া যেভাবে প্ররোচিত হয়ে থাকুক, তারা (বিডিআর সদস্য) সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের বাহিনীতে চাচ্ছিল না। বিডিআরের ভেতরে নানা ধরনের সংকট ছিল, যা আমরা তদন্তে পেয়েছি।

তিনি বলেন, কমিশনের তদন্তে বিদ্রোহের প্রকৃত কারণ হিসেবে উঠে এসেছে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা, প্রতিবেশী একটি দেশ বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা। প্রতিবেশী দেশটি ছিল বেনিফিশিয়ারি।

বিডিআর বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে গুম করা হয়েছিল—এই ঘটনার কোনো প্রমাণ পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। পিলখানার ৫ নম্বর গেটে র্যাবের সদস্যরা মোতায়েন ছিল। সেই সময়ে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল রেজা নুর। পিলখানায় হত্যাকাণ্ড চললেও তারা কোনো ভূমিকা রাখেনি। কারণ কর্নেল রেজা নুর নিষেধ করেছিল। যখন এই ধরনের বিদ্রোহ হয় তখন র্যাব, পুলিশের কোনো আদেশের প্রয়োজন হয় না। এই বিষয়টা আমরা সুপারিশ করেছি।

অপারেশন ডাল-ভাত নিয়ে ক্ষোভের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে আসলে কী ঘটেছে জানতে চাইলে কমিশনের প্রধান বলেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করা ও বিডিআরকে দুর্বল করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এটাকে আড়াল করে অপারেশন ডাল-ভাত ও আর্মি অফিসারদের বিষয়ে ক্ষোভকে সামনে আনা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিডিআরে নানা ধরনের ইস্যু ছিল। এ ছাড়া সেনাবাহিনীতে একটা নিয়ম আছে, যে একজন অফিসার তিনবার বোর্ডে সুপারসিডেট হলে তার আর পদোন্নতি হয় না। এই বিদ্রোহের যারা সরকারকে সহযোগিতা করেছে তাদের মধ্যে এই সুপারসিডেট কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি। এমনকি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে সুপারসিডেট ছিলেন। তার চাকরি থেকে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিদ্রোহের পরে তাকে পদোন্নতি দিয়ে বিজিবি প্রধান ও পরে সেনাপ্রধান করা হয়েছে। এভাবেই ওই সকল সেনা কর্মকর্তাদের পরে পদোন্নতি দিয়ে ভালো ভালো জায়গায় পদায়ন করা হয়েছে। দুর্বল জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে সরকার নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তারা এটা করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ওই সময় প্রতিবেশী একটি দেশের ৯২১ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল, তাদের মধ্যে অনেকের হিসাব মেলেনি। সরকারকে প্রতিবেশী দেশটির কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা চাইতে সুপারিশও করেছে তদন্ত কমিশন।

বিদ্রোহ দমনে সেনা অভিযান না হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কমিশনের প্রধান বলেন, সেনা অভিযান না হওয়া একটি মূল ষড়যন্ত্র। সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন বিদ্রোহের সময় সেনা সদর ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যান। তিনি দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ছিলেন। তার সঙ্গে নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরাও ছিল। ফলে নিয়ন্ত্রণ শূন্যতা তৈরি হয়। সেই সময়ে বিডিআর বিদ্রোহ দমনে কমান্ড করার মতো কোনো কর্মকর্তা ছিল না। যারা ছিল তাদের অনেককে মেরে ফেলা হয়েছিল। অনেকে বের গেছে, কাউকে জিম্মি করা হয়েছিল। সেই সময়ে আক্রমণ করলে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা পরাজিত হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। দুই দিনে যখন একটি দেশে ৫৭ জন কর্মকর্তা নিহত হয়, সে দেশের স্বাধীনতা থাকে না। ৪৬ ব্রিগেডকে প্রথমে পাঠানো হলেও পরবর্তী সময়ে সেনা মোতায়েন পেছনে সরিয়ে দেওয়া হয়।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান বলেন, এটি ছিল পরিকল্পিত। বিদ্রোহ দমনে সেনা অভিযান হলে শহরের তিন কিলোমিটার দূরে সরিয়ে আর্মিকে রাখা হতো না। কমিটির তদন্তে সেনা কর্মকর্তাদের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্রও উঠে এসেছে। ভুক্তভোগী সেনা কর্মকর্তাদের স্বজনসহ বিভিন্ন ব্যক্তির জবানবন্দিতে উঠে এসেছে, কারও চোখ তুলে ফেলা হয়, কারও পা ভেঙে দেওয়া হয়, শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলা ও বাসায় লুটপাট করা হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তে একাধিক সাক্ষ্যে দেখা যায়—বিদ্রোহে শুধু বিডিআর সদস্যই নয়, বাইরে থেকেও মানুষ অংশ নেয়। তাদের মধ্যে অনেকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য ছিল বলেও সাক্ষ্যে উঠে এসেছে। ২০-২৫ জনের দল বিদ্রোহস্থলে ঢুকে পড়ে ২০০ জনের একটি মিছিল বের হয়ে যায় বলেও কমিটি জানিয়েছে।

বিডিআর বিদ্রোহে গোয়েন্দা ব্যর্থতা পাওয়া গেছে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, গোয়েন্দা ব্যর্থতা পর্বত পরিমাণ ছিল। গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছি। আমরা নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। বিভিন্নভাবে আমরা সে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। তদন্ত কমিটির কাছে তৎকালীন সেনাপ্রধান বলেছেন, সেইসময়ে সেনা অভিযান হলে প্রতিবেশী একটি দেশ হস্তক্ষেপ করত এবং ১৯৭১ সালে ফিরে গেলেও ২০০৯ সালে তারা ফিরে যেত না।

সংবাদ সম্মেলন শেষে তদন্ত কমিটির সভাপতি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা যদি এই ঘটনার সঠিক মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আগামীতে আবারও বিদ্রোহ ঘটতে পারে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সত্য প্রকাশ ও প্রতিকার জরুরি।

এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতি দীর্ঘদিন অন্ধকারে ছিল। তদন্ত কমিশন সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছে, জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে কমিশনের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ইতিহাসের এই ভয়াবহতম ঘটনা নিয়ে জাতির অনেক প্রশ্ন ছিল, এই কাজের মধ্য দিয়ে সেসব প্রশ্নের অবসান ঘটবে। এই প্রতিবেদনে শিক্ষণীয় বহু বিষয় এসেছে। জাতির জন্য মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকবে এটি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পরিবারকল্যাণ কর্মীদের ১০ দিনের কর্মবিরতি ঘোষণা

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া ও সদকায়ে জারিয়া

শেবাচিম হাসপাতালে চালু হলো মৃগী রোগীদের ইইজি পরীক্ষা

রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেসব সুবিধা পান

মশা নিধনে আমেরিকান প্রযুক্তির বিটিআই ব্যবহার শুরু করল চসিক

ববি শিক্ষার্থীকে রাতভর র‌্যাগিংয়ের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

এনসিপির কমিটি নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে, সাংবাদিকদের হেনস্তা-তালাবদ্ধ করার হুমকি

খালেদা জিয়ার অসুস্থতার জন্য আ.লীগ সরকার দায়ী : মুশফিকুর রহমান

আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ছুটি চাইলেন বার্সা ডিফেন্ডার

খালেদা জিয়াকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত ভারত : মোদি

১০

বন্ধুকে কুপিয়ে হত্যার কারণ জানালেন অস্ত্র হাতে থানায় যাওয়া যুবক

১১

প্রাইভেটকারচাপায় প্রাণ গেল সাবেক ইউপি সদস্যের

১২

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ নরেন্দ্র মোদির

১৩

আরব আমিরাতে অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন শুরু, প্রবাসীদের উচ্ছ্বাস

১৪

টিউলিপ সিদ্দিকের রায় নিয়ে যা বলছে লেবার পার্টি

১৫

সিলেট নয় ঢাকাতেই শুরু হবে বিপিএল

১৬

খালেদা জিয়ার জানের সাদকা হিসেবে ছাগল দান বিএনপি নেতা আজাদের

১৭

নগরজুড়ে আতঙ্ক, চট্টগ্রামে ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে অপরাধীরা

১৮

রাজশাহীতে জিয়া পরিষদের সভাপতি ড. নেছার উদ্দিন ও সম্পাদক সালাউদ্দিন

১৯

গাড়িতে মাথা ঘোরা-বমি ভাব? সাহায্য করবে আইফোনের এই গোপন ফিচার

২০
X