আফসান চৌধুরী
প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ লেখা

একাত্তর শুরু হলো কবে থেকে

একাত্তর শুরু হলো কবে থেকে

একাত্তরটা শুরু হলো কবে থেকে? এ প্রশ্ন আমার সারা জীবনের। আমার মতে, একাত্তরটা শুরু হয়েছে বিভিন্ন সময় থেকে। একাত্তর সাল ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারিতে শুরু হয়নি, এর ইতিহাসের শিকড় চলে গেছে ২০০ বছর, ৫০০ বছর গভীরে। যখনই যে অত্যাচার, যে নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ দাঁড়িয়েছে—তখন থেকেই এ ইতিহাসের শুরু। ছোট, ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য—তবু তখনই শুরু হয়েছে। আর্যদের দখল করা, মোগলদের দখল করা, তুর্ক-আফগানদের দখল করা, ইংরেজদের দখল করা, পাকিস্তানের দখল করা দেশে যে মানুষ চাষ করেছে, সংসার চালিয়েছে—সে মানুষই বিদ্রোহ করেছে। বিদ্রোহী সে এবং সে-ই বাংলাদেশের ইতিহাসটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেটা আমরা বুঝতে পারি না, কারণ, আমরা শুধু সশস্ত্র বিদ্রোহের চোখ দিয়ে বিদ্রোহকে দেখতে পাই, দেখতে চাই। আমাদের ইতিহাসের এ সেনাকরণ একটি বড় সমস্যা, যা থেকে আমরা দূরে চলে যেতে পারব না; কারণ, সেটা হচ্ছে শক্তির উৎস। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্ম তখনই হয়েছে, যখন বাংলাদেশের মানুষ বলেছে যে, আমি যুদ্ধটা করতে চাই। বাংলাদেশের মানুষ কখনো বলেনি, আমি অন্য কাউকে আক্রমণ করব। তারা বলেছে যে, তুমি যদি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার চেষ্টা করো, আমি তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব এবং তারা করেছে। একজন সাধারণ কৃষক যখন অস্ত্র হাতে নিয়েছে, সেখানে পরিবর্তনটা কত মৌলিক সেটা আমরা হয়তো ভাবতেই পারব না। সেনাবাহিনী তো অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্যই প্রশিক্ষিত। সেটাই তাদের কাজ। একজন বেতনভোগী যোদ্ধা আর অন্যজন যে বিনা বেতনে জীবনের সবকিছু বাজি রেখে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে—তার মধ্যে মৌলিক তফাত রয়েছে। সেও রাষ্ট্রের অংশ। তবে একজন প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র, অন্যজন জনগণের রাষ্ট্র। সামাজিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হচ্ছে এ কৃষকশ্রেণির সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে। আমাদের অনেকে বলে থাকেন, এই যে মুক্তিযুদ্ধ—এখানে মুক্তি কারা পেয়েছে? হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, প্রাতিষ্ঠানিক দুনিয়ায় মুক্তি আসলেই কম হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক দুনিয়া এখনো প্রাতিষ্ঠানিক এবং সেখানে অনেক জায়গায় এখনো পাকিস্তানি কাঠামো বা চেহারা পাওয়া যায়। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক দুনিয়া অনেক সামনে চলে গেছে। আজকে গ্রামের কৃষক-হাইল্লাকে মধ্যবিত্তের বলার দরকার নেই যে, তোমার এইটা করলে ভালো হবে, ওইটা করলে মন্দ হবে। যেটা ইতিহাসে একাত্তর পর্যন্তই ছিল। সুতরাং, একাত্তরটা সে কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, কৃষক মুক্ত হয়ে গেল। কৃষক এই যে অর্থনীতিতে সবল হওয়া শুরু করল, সেটা যত দুর্বলভাবেই হোক, আজকে এসে সমাজের সবচেয়ে সবল শ্রেণি হচ্ছে কৃষকশ্রেণি। বড়লোক তো থাকে কানাডায়; তাকে নিয়ে তো আমাদের চিন্তা করার কিছু নেই।

বাংলাদেশের যে মাটি—এ ভূখণ্ডের মালিক কিন্তু এখন কৃষকশ্রেণি। কারণ মধ্যবিত্ত যে শ্রেণি—তার তো কোনো শক্তিই নেই, ক্ষমতাই নেই। ও তো হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে মধ্যস্থতাকারী। সে মধ্যস্বত্বভোগী। এখন তো আর সেই মধ্যস্বত্বভোগীর দরকার নেই। এই মধ্যস্বত্বভোগীর বিলুপ্তিটা শুরু হলো একাত্তর সালেই। হয়ে সবচেয়ে সুবিধাবান হয়েছে কৃষক সমাজ, সাধারণ মানুষ। আজকে গার্মেন্ট কারখানায় এসে কাজ করে যে মেয়েটা বাংলাদেশকে ধনী করে, হতে পারে তার জীবনে হাজারটা কষ্ট আছে; কিন্তু সে এ সুযোগটা একাত্তরের আগে পায়নি। যে কারণেই হোক, আজকে সে পাচ্ছে, সে সেই সুযোগটা নিচ্ছে এবং সবল হচ্ছে। সে মুক্ত হয়েছে। আজকে আর গ্রামে গিয়ে দশটা কথা বলে বোঝানো যাবে না, একাত্তর সালেও যায়নি। বোঝানো গেলে তো রাজাকারদের পক্ষেই দেশের সব কৃষক চলে যেত। কিন্তু তারা যায়নি। কেন যায়নি? কারণ, তারা মেধাবী। ভারতীয় ইতিহাসবিদরা অনেক সময় বলেন যে, এ দেশের মানুষরা বিভিন্ন সময় মুরুব্বিদের কথা শুনে চলেছে। এটা একদমই বাজে কথা। বাংলাদেশের কৃষক মুরুব্বিদের কথা সবচেয়ে কম শোনে। ওর মতো সুবিধাবাদী, ওর মতো স্বার্থপর কমই আছে এবং সে কারণেই ও টিকে আছে। ও জানে ওর ইতিহাসটা কী। ও বলে যে, ‘আমি শুনুম না তোমার কথা, আমি আমার কথাই শুনুম।’ এটা একবার না, এটা সে বারবার প্রমাণ করেছে যে, সে শুধু নিজের কথাই শোনে। আজকে বাংলাদেশটা সম্ভব হতো তাকে ছাড়া? বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল সম্ভব হবে কৃষককে বাদ দিয়ে? কৃষক পাত্তাই দেয় না শহরের রাজনীতিকে। কৃষক পাত্তাই দেয় না শহরের কাঠামোকে। সে মনে করে, শহরের লোকেরা এলে এলো, না এলে না এলো। ও নিজে আয় করে, নিজে চলে—ফেসবুকে কী বলল না বলল, তাতে ওর কিচ্ছু আসে যায় না। মধ্যবিত্তের তো ফেসবুক ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সেটা কৃষকের কোনো দরকারই না। কৃষক নিজে অর্থনীতি তৈরি করছে, নিজে সবল হচ্ছে। কতটা সবল—সেটা বোঝা যায় মাঝেমধ্যে যখন কৃষকের ওপরে কারোর কিছু বলার সাহস থাকে না। তাকে শেষ পর্যন্ত গিয়ে মেনে নিতে হয়। আর মধ্যবিত্তের কথা মানে কেউ? না, মানে না। বড়লোক তো চুরিচামারি করে যাচ্ছে—আচ্ছা করুক, কিন্তু কতদিন করতে পারবে? বাংলাদেশ আজকে অবস্থাপন্ন। এত চুরির পরও ৫৪ বছরে অনেক হিসাবে বাংলাদেশ আজকে ভারতের কাছাকাছি পৌঁছেছে আর পাকিস্তানকে তো আগেই ফেলে দিয়েছে। আমার মনে আছে, ২৫ বছর আগে পাকিস্তানিরা আমাদের কী গালি দিত! কিন্তু এখন সে আর গালি দিতে পারে না। কারণ সে জানে, বাংলাদেশ আজকে সবদিক থেকে পাকিস্তানের চেয়ে ভালো। এই যে অবস্থা—এটা কি আমরা করেছি? এটা করেছে এই কৃষকসমাজ। কৃষিক্ষেত্র থেকে শুরু করে সবক্ষেত্রে এসে বাংলাদেশের কৃষকসমাজের সাধারণ মানুষই দেশটাকে সবল করেছে। এই শক্তি তো আগে ছিল না। কৃষকসমাজ এ শক্তিটাই প্রকাশ করার সুযোগটা পেয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। এ শক্তিটাকে ধরতে পারি না বলেই আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বুঝতে পারি না। কারণ, আমরা দেখতে চাই মধ্যবিত্ত চোখ দিয়ে—প্রাতিষ্ঠানিক দুনিয়ায় কে কী বলল না বলল, সংবিধানের কী হলো না হলো।

আমি একবার একটা গবেষণা করেছিলাম যে, সংবিধান কতদূর পর্যন্ত যায়? আসলে ঢাকা শহরের বাইরে সংবিধান যায় না। সেই সমাজ, যে সমাজের সংবিধান যথেষ্ট সবল নয়, সে সমাজের মানুষ কতটা সবল হলে সে সংবিধানমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে?

আমরা যারা একাত্তর নিয়ে গবেষণা করি—তারা মনে করি যে, একটা দেশে প্রাতিষ্ঠানিক আর অপ্রাতিষ্ঠানিক দুটি শক্তি থাকে; একাত্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ছিল মুজিবনগর সরকার এবং আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনীর মানুষ, রাজনীতিবিদ ও আমলারা। তারা একটা ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, তাদের প্রবলভাবে সহায়তা করেছে ভারত। সেটা অত্যন্ত ধন্যবাদের সঙ্গেই আমাদের স্মরণে রাখা দরকার। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক যে সমাজ বা সামাজিক শক্তি—সেটা কারও সহায়তার জন্য অপেক্ষা করেনি। সে নিজে থেকেই নিজে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে এবং সেটাই তার ইতিহাসের একটি বড় বিজয়। সে যে স্বাধীন—সেটা সে নিজের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধের এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই প্রমাণ করেছে যে, আমি স্বাধীন। এখন আর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় ও পাকিস্তানি ইতিহাসের তুলনা করা যায় না। কারণ, দুটিই ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে হাত-পা জড়িয়ে থেকে, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া ও সমঝোতা করে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ করেনি। বাংলাদেশ যুদ্ধ করে বের হয়ে এসেছে। এই যে মৌলিক পার্থক্যটা—এটা কোনোদিন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশের ইতিহাসে আমরা যুদ্ধটাকে খুব মহান করেছি, এর প্রভাবটা, অর্থাৎ আমি যে কোনো শক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে আসিনি, আমি বোঝাপড়ার মাধ্যমে স্বাধীন হইনি। সেটাকে বড় করে তুলে ধরা হয় না। মূলত তাকেই প্রকাশ করা দরকার সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, কৃষক-শ্রমিক সাধারণ সমাজ যে স্বাধীন—সেটা তারা বলেছে, প্রমাণ করেছে এবং প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের হাজারটা কষ্ট হোক, তবু তারা সেটা প্রমাণ করেছে। তারা স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের কারও কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কিছু নেই। তারা যত খারাপ হোক, তারা তাদের নিজেদের শক্তিতেই স্বাধীন। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশ, এটাই বাংলাদেশের একাত্তর।

আফসান চৌধুরী

সাহিত্যিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

এবার মুখ খুললেন শুভশ্রী

জরুরি অবতরণকালে বিমান বিধ্বস্ত, তিনজন ছাড়া সব আরোহী নিহত

চট্টগ্রামে বিজয় দিবস, শহীদদের প্রতি সর্বস্তরের শ্রদ্ধা

শরীরে নীরব ঘাতক ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, জেনে নিন ৮ লক্ষণ

পতাকা হাতে প্যারাট্রুপিং করে বিশ্বরেকর্ড বাংলাদেশের

পদ্মা সেতুতে থেমে থাকা বাসে আরেক বাসের ধাক্কা, অতঃপর...

আ.লীগ ৫০ প্রার্থীকে হত্যার মিশন নিয়েছে : রাশেদ খান

পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে তিন জাহাজে মার্কিন হামলা, নিহত ৮

স্বাধীনতার শত্রুরা আবার মাথাচাড়া দিতে চায় : মির্জা ফখরুল

আইইএলটিএস পরীক্ষায় বড় পরিবর্তন, কার্যকর ফেব্রুয়ারিতে

১০

রিয়ালে খেলা ডিফেন্ডারকে দলে নিল ইন্টার মায়ামি

১১

আইপিএল নিলাম আজ: যেসব বিষয়ে জানা জরুরি

১২

অ্যাডিলেড টেস্টের আগে অজি একাদশে বড় পরিবর্তন

১৩

খুবিতে যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যে মহান বিজয় দিবস উদযাপিত

১৪

মির্জা আব্বাস / গোলাম আযম-নিজামীকে ‘সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেছে জামায়াত

১৫

আইপিএল ২০২৬-এর সূচি জানাল বিসিসিআই

১৬

জাতিসংঘে পাকিস্তানকে তুলাধুনা ভারতের

১৭

পুলিশের বিশেষ অভিযানে আ.লীগ নেতা ও সাবেক মেয়র গ্রেপ্তার

১৮

সন্দেহভাজন হামলাকারীরা ভারতে, সীমান্তে যেতে ৫টি যানবাহন পাল্টান তারা

১৯

বাংলাদেশের বোলিং কোচ হওয়ার প্রশ্নে যা বললেন শোয়েব

২০
X