শারদীয় দুর্গাপূজার পর চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার চিন্তা করছে বিএনপি। তার আগে ঢাকায় মহাসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচি থেকে সরকারকে পদত্যাগ করতে সময়সীমা বেঁধে (আলটিমেটাম) দিতে পারে দলটি। দাবি না মানলে পূজার পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে ‘অলআউট আন্দোলন’ শুরু করতে চান তারা। মধ্য অক্টোবরে ঢাকায় যুব ও ছাত্র কনভেনশন আয়োজনের চিন্তা রয়েছে দলটির। তবে ২০ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত দুর্গাপূজার সময়ে বড় কোনো কর্মসূচি রাখবে না বিএনপি। মার্কিন ভিসা নীতি কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নভেম্বরের শুরুতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই আন্দোলন চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় দলটির হাইকমান্ড। কোনো কারণে ওই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় সম্ভব না হলে তপশিল ঘোষণার পরও আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত দুদিনে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ, গণঅধিকার পরিষদ (নুর), এনডিএম এবং গণফোরাম (মন্টু) ও বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) সঙ্গে পৃথক বৈঠকে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলন নিয়ে এমন প্রাথমিক চিন্তাভাবনার কথা জানায় বিএনপি। একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি নির্ধারণে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যুগপতের শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে দলটি। এসব বৈঠকে শরিকদের পক্ষ থেকেও আন্দোলনের বিভিন্ন প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। আজ রোববারের মধ্যে অন্য সমমনাদেরও মতামত নেবে বিএনপি। এরপর আগামীকাল সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় মিত্র দল ও জোটের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে।
চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রথম ধাপে বিএনপি এখন রোডমার্চ ও সমাবেশের কর্মসূচি পালন করছে। আগামী ৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোডমার্চের মধ্য দিয়ে এ পর্যায়ের কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। এরই মধ্যে রাজধানী ও এর আশপাশের জেলায় ছয়টি সমাবেশ হয়েছে। রোডমার্চ হয়েছে তিনটি। এ ছাড়া ঢাকায় মহিলা সমাবেশ ও শ্রমিক কনভেনশন হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন, এসব কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। চলমান কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর আরও শক্তভাবে মাঠে নামবেন তারা, যা হবে সরকার পতনের চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘একদফা দাবি আদায়ে যুগপৎ আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলনে এরই মধ্যে জনগণ সম্পৃক্ত হয়েছে। আগামীতে আন্দোলনের কী কর্মসূচি আসবে, তা পরিস্থিতিই বলে দেবে। যখন যে কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে, তখন সে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনের সম্ভাব্য কর্মসূচি নিয়ে দলীয় চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। বৈঠক সূত্র জানায়, অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় যুগপৎ আন্দোলন বেগবান করবে বিএনপি। এ সময়ে যুব ও ছাত্র কনভেনশন করার ব্যাপারে আলোচনা হয়। ছাত্র কনভেনশনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বটতলায় করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। এদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে শারদীয় দুর্গাপূজা করতে পারেন, সেজন্য ২০ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত পূজা চলাকালীন বড় কোনো কর্মসূচি রাখছে না বিএনপি।
বৈঠক সূত্র আরও জানায়, ১৮ অক্টোবরের দিকে ঢাকায় বড় সমাবেশ করে সরকারকে পদত্যাগে আলটিমেটাম দিতে পারে বিএনপি। দুর্গাপূজা শেষ হওয়া পর্যন্ত এ আলটিমেটাম চলতে পারে। তবে সরকার আলটিমেটাম মেনে পদত্যাগ না করলে, তখন আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে নামবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। সেক্ষেত্রে ঘেরাও দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের এ আন্দোলন শুরু হতে পারে। শুরুতেই সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে তারা। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। একেবারে বাধ্য না হলে হরতালের মতো কর্মসূচিতে যাবে না বিএনপি।
মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকে হরতালের বিষয়টি আলোচনা এসেছে। অধিকাংশ নেতা হরতালের পক্ষে মতামত দিলেও বিএনপি মহাসচিব আপাতত এ ধরনের কর্মসূচি না দিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এর আগে ১৫ থেকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এবং প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) বরাবর স্মারকলিপি দেওয়ার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। স্মারকলিপিতে পুলিশকে বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অন্যায়ভাবে হামলা-মামলা, নির্যাতন না চালিয়ে জনগণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানানো হতে পারে।
বিএনপি নেতারা জানান, চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে বিএনপি ও তার মিত্রদের কর্মসূচি কেমন হবে, তা সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে। সরকারের আচরণ কঠোর হলে কর্মসূচিও কঠোর হবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার পর তার মনোভাব কেমন হয়, তা পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি ও তাদের শরিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, সরকার প্রধানের আচরণ নির্ধারণ করবে বিরোধী পক্ষের কর্মসূচির ধরন কেমন হবে।
বিএনপি ও যুগপতের শরিকরা জানান, চূড়ান্ত ধাপের কর্মসূচি হবে লাগাতার এবং রাজধানী ঢাকার ওপর থাকবে আন্দোলনের মূল ফোকাস।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু কালবেলাকে বলেন, ‘একদফা দাবিতে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছি। চলমান কর্মসূচি শেষে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। দাবি না মানলে আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হবে। এসব বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি।’
মঞ্চের নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সামনে কীভাবে আন্দোলনকে আরও বেগবান করা যায়—এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শ্রমিক কনভেনশনের পরে ঢাকায় ছাত্র কনভেনশন, পেশাজীবী কনভেনশনসহ আরও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’
শরিকদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। তাতে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিএনপি জার্মানি অথবা যুক্তরাজ্যে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করাতে চাচ্ছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নেওয়ার শর্তের কথা বলা হচ্ছে। তবে খালেদা জিয়া বিএনপি নেতাদের জানিয়েছেন, কোনো শর্ত মেনে তিনি চিকিৎসা করাতে চান না।
এদিকে একদফার আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ বিরোধী ১৫ ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গত শুক্রবার ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্য’ নামে নতুন ছাত্র জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো এর পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী যুবদলের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠন নিয়ে ‘যুব ঐক্যজোট’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রাথমিক আলোচনাও শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।