শেখ হারুন
প্রকাশ : ২১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ০১:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঠিকাদারে নাস্তানাবুদ গৃহায়ন

ঠিকাদারে নাস্তানাবুদ গৃহায়ন

বিবিএল-কম্প্রিহেনসিভ হোল্ডিং লিমিটেড (জেভি) নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে—এমন কোনো প্রকল্পের কাজই যথাসময়ে শেষ করতে পারছে না সংস্থাটি। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এরই মধ্যে একটি প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। আরেকটির চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে। এমন অবস্থায় প্রকল্পগুলো শেষ করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ফ্ল্যাট বরাদ্দপ্রাপ্তরা। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কাজ নেওয়ায় কোম্পানিটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রকল্প পরিচালক। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, সরকারি প্রকল্পের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও নির্দিষ্ট প্রকল্পের কাজ না করে কোম্পানিটি নিজস্ব প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। গৃহায়নের একাধিক প্রকৌশলী জানান, এ কারণে সরকারি প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হচ্ছে না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গৃহায়ন কর্তৃক সময়মতো লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে না পারা এবং নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রামের হালিশহর হাউজিং এস্টেটের ‘মাল্টিপারপাস টাওয়ার’ ভবনের নির্মাণকাজ। সাড়ে ছয় বছর মেয়াদি প্রকল্পের পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও কাজের অগ্রগতি সামান্য। ২২৩ কোটি টাকার প্রকল্পে খরচ হয় মাত্র ৩৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৪ শতাংশ। প্রকল্পে বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ২৬ শতাংশ। এরপর কম্প্রিহেনসিভ হোল্ডিং লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, মাল্টিপারপাস টাওয়ার নির্মাণ প্রকল্পের কাজের জন্য ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কম্প্রিহেনসিভ হোল্ডিং লিমিটেডের সঙ্গে ১৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার চুক্তি করে এনএইচএ। চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা ছিল। কাজ সমাপ্তির সময়কাল শেষ হলেও চার বছরে ঠিকাদার ভৌত কাজ করেছে মাত্র ২১ শতাংশ।

এনএইচএ সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণকাজে ধীরগতির কারণে বারবার ঠিকাদারকে নোটিশ দিয়ে সতর্ক করা হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে চুক্তি বাতিলের কারণে ঠিকাদার মামলা করলে নির্মাণকাজে স্থিতাবস্থা জারি করেন আদালত। বর্তমানে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

মাল্টিপারপাস টাওয়ারের প্রকল্প পরিচালক তাওফিকুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে কাজ করছিল না। বেশ কয়েকবার নোটিশ দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। তিনি বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ার অজুহাত দিলেও তা বাস্তবসম্মত নয়। কেননা দাম যখন কম ছিল তখনো কাজে ধীরগতি ছিল।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি গৃহায়নের শুধু এই প্রকল্প নয়, চট্টগ্রামের আরও তিনটি এবং রাজধানীর মিরপুরের একটিসহ মোট পাঁচটি প্রকল্পের কাজ পেয়েছে। সেগুলোতেও ঠিকমতো কাজ এগোচ্ছে না বলে জানা গেছে।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের একাধিক প্রকৌশলী কালবেলাকে বলেন, কম্প্রিহেনসিভ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আমাদের একবারে সর্বনাশ করে দিয়েছে। কাজ শেষ না হওয়ায় বারবার সময় বাড়ানোর আবেদন করতে হচ্ছে। আর সময় বাড়ানো মানে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যাওয়া। এ ছাড়া বিক্রির পরও গ্রহীতাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তারা বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্পগুলোর কার্যাদেশ নেওয়ার পর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। প্রকল্প শেষ করলে ঋণ শোধ করতে হবে। এ কারণে ফেলে রাখা হচ্ছে।

‘চট্টগ্রামস্থ হালিশহর হাউজিং এস্টেটের জি ব্লকে আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প (৪র্থ পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে কম্প্রিহেনসিভ হোল্ডিং। এই প্রকল্পেও এক বছর ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে। ধীরগতির কারণে এই প্রকল্পেও কম্প্রিহেনসিভের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প পরিচালকের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রকল্পের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে ঠিকাদারের ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে চুক্তি বাতিলের বিষয়ে ২৮ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন নির্বাহী প্রকৌশলী। চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকাদার বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে জবাব দিলেও সেখানে গরমিল দেখা যায়।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, সীমিত আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য জি ব্লকে ৩১২টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্টে। প্রকল্পের আওতায় ১৪ তলাবিশিষ্ট ৬টি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এ কাজের জন্য কম্প্রিহেনসিভের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে ১৯৭ কোটি ৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। প্রায় পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের অগ্রগতি ২২ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন দেওয়ান কালবেলাকে বলেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এখানে কাজ করে না বললেই চলে।

চট্টগ্রামের ফিরোজশাহ হালিশহরে ৩৪২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। সেখানেও কম্প্রিহেনসিভের কারণে কাজ চলছে ঝিমিয়ে। এটাও নির্ধারিত সময়ে শেষ করা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। গত বছরের জুনে মেয়াদ শেষ হলেও চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে শেষ হবে না।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের কাজ ধীরগতির হলেও তাদের দিয়ে কাজ শেষ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে নতুন প্রক্রিয়ায় গেলেই ব্যয় বেড়ে যাবে। যেহেতু এটার বরাদ্দ দেওয়া, এ কারণে কাজ শেষ করার জন্য সবাই মিলে চেষ্টা করা হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ‘স্বপ্ন নগর ২য় পর্যায়’ প্রকল্পের ১৫টি ভবনের মধ্যে ৫টি ভবন নির্মাণের কাজ করছে কম্প্রিহেনসিভ। সেখানেও একই অবস্থা। চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত গড় অগ্রগতি ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ। জানা গেছে, এই প্রকল্পে অন্য ঠিকাদাররা ঠিকমতো কাজ করলেও কম্প্রিহেনসিভের কাজে রয়েছে ধীরগতি। কম্প্রিহেনসিভের কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় আবারও প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে পরিচালক ও এনএইচএর সদস্য বিজয় কুমার মণ্ডল কালবেলাকে বলেন, এখানে ১৫টি ভবনের মধ্যে ৫টি ভবন নির্মাণের কাজ করছে কম্প্রিহেনসিভ। তাদের কাজের অগ্রগতি অন্য ঠিকাদারদের চেয়ে কম। এ কারণে চলতি বছরের জুনে মেয়াদ শেষ করার কথা থাকলেও ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্ধিত সময়ের বাকি কাজ তারা কীভাবে করবে, সেটার রোডম্যাপ দিতে বলা হয়েছে।

কম্প্রিহেনসিভ হোল্ডিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শাহ মোহাম্মদ মাসুদ ইব্রাহীম কালবেলাকে বলেন, সময়মতো নকশা দিতে পারেনি গৃহায়ন। এ ছাড়া সাইট বুঝিয়ে দিতেও তারা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছে। সময়মতো তারা লজিস্টিক সাপোর্টও দিতে পারেনি। এসব কারণে নির্মাণকাজ সঠিক সময়ে শেষ হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া করোনা এবং পরবর্তী সময়ে নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু গৃহায়নের সঙ্গে চুক্তি আগের মূল্যে। এখন বর্ধিত দামে কাজ করতে হচ্ছে। এসবও কাজের ধীরগতির অন্যতম কারণ।

চুক্তি বাতিলের বিষয়ে মাসুদ ইব্রাহীম বলেন, এটা আদালতে বিচারাধীন, গৃহায়নের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এসব প্রকল্পে অন্যরা কীভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা নানা কারণে করতে পারিনি। যার যেমন সংগতি সেভাবেই কাজ করে। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি কাজ নেওয়ায় এমন হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পারব বলেই কাজ নিয়েছি।

গৃহায়নের চেয়ারম্যান মো. মুনিম হাসান কালবেলাকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার কারণে বেশিরভাগ কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন ঠিকাদার কাজ করছে। কম্প্রিহেনসিভের কাজগুলোতেই ধীরগতি বেশি। এসব প্রকল্পে গতি আনতে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

যাদের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, গৃহায়নের প্রকল্পগুলোর জন্য তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে।

স্বপ্ন নগরের বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এখানে আমাদের কিছু সমস্যা ছিল। কারণ আমরা সময়মতো নকশা দিতে পারিনি। এটা তারা ধীরগতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এই সমস্যা তো অন্যদের ক্ষেত্রেও ছিল; কিন্তু তাদের কাজে তেমন সমস্যা হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

স্বাস্থ্য পরামর্শ / রান্নায় সরিষার তেলে ঝুঁকি ও অসংক্রামক রোগ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে আবারো দুর্ঘটনা, নিহত আরও ৩

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে ৫৮% মার্কিনি : রয়েটার্স

স্পেনের বাইরে লা লিগার ম্যাচ খেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাল ফুটবলাররা

দুবাইয়ে যাওয়ার ৪ মাস পরই ৩ কোটির লটারি জিতলেন প্রবাসী

এনজো ফার্নান্দেজের মুখে রিয়াল মাদ্রিদের নাম, বাড়ছে গুঞ্জন

কেশবপুরে নারী সমাবেশ/ / ধানের শীষের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

সাভারে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দাওয়াতি মাসের শুভ উদ্বোধন

তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন, নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রীও হবেন : এ্যানি

দলবদলের বাজারে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর রেকর্ড ভাঙা খরচ

১০

ধর্মগড় সীমান্তে বিজিবির হাতে আটক চার বাংলাদেশি

১১

হাসিনাকে ফেরত পাঠানো নিয়ে মোদিকে ওয়েইসির প্রশ্ন

১২

জাকসুতে প্যানেল দ্বন্দ্ব, পদত্যাগ করে বাগছাস নেতার মিষ্টি বিতরণ

১৩

সৈয়দপুর বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা আন্তর্জাতিক মানের করতে চাই : বেবিচক চেয়ারম্যান

১৪

‘আ. লীগ বিদ্যুৎ খাতে চুরির লাইসেন্স দিয়েছিল’

১৫

আ.লীগ নেত্রী রুনু গ্রেপ্তার

১৬

ইসির ইউটিউব চ্যানেল চালু, মিলবে যেসব তথ্য

১৭

শিশু ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ, গ্রেপ্তারের দাবি শিক্ষার্থী

১৮

চার বিভাগে ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি, পাহাড়ধসের আশঙ্কা

১৯

ভোলায় পাঁচ দিন ২০ নৌরুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ, ভোগান্তি চরমে

২০
X