দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে সারা দেশে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ৭৩১ জনের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি), যা মোট মনোনয়নপত্র জমার প্রায় ২৭ শতাংশ। বাছাইয়ে ১ হাজার ৯৮৫ প্রার্থীর মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। মনোনয়ন বাতিল হওয়াদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত চারজন প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরও মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। প্রার্থিতা ফিরে পেতে আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে আপিল গ্রহণ, যা ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। ১০ ডিসেম্বর থেকে আপিল শুনানি শুরু হবে এবং চলবে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আপিল জমার জন্য এরই মধ্যে নির্বাচন ভবনে ১০টি অঞ্চলের জন্য ১০টি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। ১০ জন কর্মকর্তার কাছে আপিল আবেদন জমা দিতে পারবেন মনোনয়ন বাতিল হওয়া প্রার্থীরা।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বৈধ ও বাতিল হওয়া প্রার্থীদের এ সংখ্যা তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকায় বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহমেদ, হলফনামায় মামলার তথ্য গোপন করায় কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে নাসিরুল ইসলাম খান, ঋণখেলাপির অভিযোগে নোয়াখালী-৩ আসনে বর্তমান এমপি মামুনুর রশিদ কিরণ ও কক্সবাজার-১ আসনে সালাউদ্দীন আহমদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। এ ছাড়া ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও শেষ পর্যন্ত দল সিদ্ধান্ত বদল করায় এ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রার্থী বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়ন বাতিল হওয়াদের মধ্যে বর্তমান সংসদের ৬ জন এমপিও রয়েছেন। বাকি চারজন এমপি হলেন নোয়াখালী-৪ আসন থেকে বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে একই দলের যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী, সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান ও চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের তিনটি আসনেই জাতীয় পার্টির (জাপার) তিন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। প্রার্থিতা বাতিলের তালিকায় আরও রয়েছেন কিশোরগঞ্জ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান, কিশোরগঞ্জ-১ আসনে সৈয়দ আশরাফের ভাই স্বতন্ত্র প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলাম, পাবনা-২ আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী, রাজশাহী-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি ও বগুড়া-৪ আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী আলোচিত ইউটিউবার হিরো আলমসহ অনেকে।
ইসি সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর সংক্রান্ত জটিলতা, বিল-ঋণখেলাপি, তথ্য গোপন, দ্বৈত নাগরিকত্বসহ নানা কারণে অনেকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মনোনয়ন বাতিল হওয়াদের আপিল আবেদন শুনানি শেষে ফলাফল মনিটরে প্রদর্শন, রায়ের পিডিএফ কপি ও আপিলের সিদ্ধান্ত রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের ইমেইলে প্রেরণ এবং নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া আপিলের রায়ের অনুলিপি নির্দিষ্ট শিডিউল মোতাবেক নির্বাচন ভবনের অভ্যর্থনা ডেস্ক থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে বিতরণ করা হবে।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ২৮টি দল (ইসির হিসাবে ২৯টি) ও স্বতন্ত্র মিলে ২ হাজার ৭১৬ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে রংপুর অঞ্চলে ২৭৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬৯ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ২০৯ জনের বৈধ, ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৩২৭ প্রার্থীর মধ্যে ৮৪ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ২৪৩ জনের মনোনয়ন বৈধ, খুলনা অঞ্চলে ৩২২ প্রার্থীর মধ্যে ৯৪ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ২২৮ জনের মনোনয়ন বৈধ, বরিশাল অঞ্চলে ১৭৩ প্রার্থীর মধ্যে ৩৮ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ১৩৫ জনের মনোনয়ন বৈধ, রাজশাহী অঞ্চলে ৩৬৯ প্রার্থীর মধ্যে ১১০ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ২৬৯ জনের মনোনয়ন বৈধ, ঢাকা অঞ্চলে ৪৩১ প্রার্থীর মধ্যে ১১৪ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ৩১৭ জনের মনোনয়ন বৈধ, ফরিদপুর অঞ্চলে ১০৩ প্রার্থীর মধ্যে ২৩ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ৮০ জনের মনোনয়ন বৈধ, সিলেট অঞ্চলে ১৬০ প্রার্থীর মধ্যে ৩৫ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ১২৫ জনের মনোনয়ন বৈধ, কুমিল্লা অঞ্চলে ৩৫৫ প্রার্থীর মধ্যে ১২০ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ২৩৫ জনের মনোনয়ন বৈধ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৮ প্রার্থীর মধ্যে ৪৪ জনের মনোনয়ন বাতিল ও ১৫৪ জনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
ইসি জানায়, এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ (নৌকা) ২৯৮টি আসনে মোট মনোনয়নপত্র দাখিল করে ৩০৩টি। পাঁচটি আসনে তাদের দুজন করে প্রার্থী রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল) ২৮৬টি আসনে ৩০৪টি মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে ১৮টি আসনে তাদের দুজন করে প্রার্থী রয়েছে। অন্যান্য দলের মধ্যে জাকের পার্টি (গোলাপ ফুল) ২১৮টি, তৃণমূল বিএনপি (সোনালি আঁশ) ১৫১টি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি (আম) ১৪২টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস (ডাব) ১১৬টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (মশাল) ৯১টি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (একতারা) ৮২টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (ছড়ি) ৭৪টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফোরাম-বিএনএফ (টেলিভিশন) ৫৫টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ৪৯টি (নোঙর), বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন-বিটিএফ (ফুলের মালা) ৪৭টি, ইসলামী ঐক্যজোট (মিনার) ৪৫টি, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ (চেয়ার) ৩৯টি, বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট (মোমবাতি) ৩৭টি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ (গামছা) ৩৪টি এবং ওয়ার্কার্স পার্টি (হাতুড়ি) ৩৩টি মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এ ছাড়া গণফ্রন্ট (মাছ) ২৫টি, জাতীয় পার্টি-জেপি (বাইসাইকেল) ২০টি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (হাতঘড়ি) ১৮টি, বিকল্পধারা ১৪টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন (বটগাছ) ১৪টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (কাঁঠাল) ১৩টি, গণতন্ত্রী পার্টি (কবুতর) ১২টি, গণফোরাম (উদীয়মান সূর্য) ৯টি, সাম্যবাদী দল (চাকা) ৬টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (কুঁড়েঘর) ৬টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল (হাত পাঞ্জা) ৫টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (হারিকেন) দুটি করে মনোনয়নপত্র দাখিল করে।
এদিকে বিএনপিসহ (ধানের শীষ) নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি (ছাতা), ইসলামী আন্দোলন (হাতপাখা), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি (কাস্তে), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি (তারা), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মই), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (গরুর গাড়ি), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (খেজুরগাছ), বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ (গাভি), বাংলদেশ খেলাফত মজলিস (রিকশা), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি (কোদাল), খিলাফত মজলিস (দেওয়াল ঘড়ি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম (সিংহ), ইনসানীয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ (আপেল) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (মোটরগাড়ি) নির্বাচনের অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে দূরে রয়েছে।
ঢাকার ২০টি আসনে ৭৮টি মনোনয়ন বাতিল, ১৫৬টি বৈধ: ঢাকা মহানগরীর ১৫টিসহ ঢাকা জেলার ২০টি সংসদীয় আসনে বৈধ প্রার্থী রয়েছেন ১৫৬ জন আর বাতিল হয়েছে ৭৮ জনের মনোনয়নপত্র। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ১৫টি আসনে ১৮৮ প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। এর মধ্যে ১২৪ জনের মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। আর ৬৪ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে মহানগরের বাইরের ৫টি আসনে ৪৬টি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে ৩২টি বৈধ আর বাতিল করা হয়েছে ১৪টি মনোনয়নপত্র।
আরও ছয়জনকে শোকজ: এদিকে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের শোকজ অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল চাঁদপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা ও একই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আলী কামালসহ আরও ছয়জন প্রার্থীকে শোকজ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। ইতোমধ্যে ৬০ জনের মতো প্রার্থীকে শোকজ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই শোকজের জবাব দিয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে ২৮টি দল ও স্বতন্ত্র মিলে দুই হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। ইসি ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কমিশনে আপিল দায়ের ও নিষ্পত্তি ৫ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রতীক বরাদ্দ করবেন ১৮ ডিসেম্বর। নির্বাচনী প্রচার চলবে ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত। আর ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি।