নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সরকারবিরোধীদের হরতাল-অবরোধে নাশকতার মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি পোড়ানোর পর এবার দুর্বৃত্তদের টার্গেটে
রেলপথ। এক সপ্তাহের মধ্যে রেলপথে অন্তত চারটি বড় নাশকতা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের তিন বগিতে দেওয়া আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন নারী, শিশুসহ চারজন।
রেল বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে ৩ হাজারের বেশি রেলপথে অন্তত ৩০০ স্পটে নাশকতার ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা রেলওয়ে জেলায় শনাক্ত করা হয়েছে ৫৫টি স্পট। দুর্গম এলাকা, বিল, নির্জন এলাকা এবং জঙ্গল এলাকা দিয়ে চলে যাওয়া এসব রেললাইনে শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দুরূহ বলেই মনে করছেন রেল বিভাগ ও রেল পুলিশের কর্মকর্তারা।
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও বলছেন, রেলের বর্তমান জনবল দিয়ে এ ধরনের নাশকতা ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন,
‘আগে বাস-ট্রাকে আগুন দেওয়া হতো, সেটা কিছুটা কমেছে। এখন রেলকেই আক্রমণের লক্ষ্য বানানো হয়েছে।’
গতকাল রেল ভবনে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেছেন, প্রতিদিন সারা দেশে ৩০০ ট্রেন চলাচল করে; এটা স্বাভাবিক থাকবে।
রেলযাত্রা নিরাপদ করতে উদ্যোগের কথা জানিয়ে এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চান মন্ত্রী। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ২ হাজার ৭০০ আনসার সদস্য চাওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে তা অনুমোদন দিয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এ এম সালাহ উদ্দীন বলেন, রেল ও যাত্রীদের নিরাপত্তায় তারা সবধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। নাশকতা হতে পারে—সারা দেশে এমন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব জায়গায় যাতে কেউ নাশকতা করতে না পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, একটা ট্রেনে ৬০০ থেকে ৮০০ যাত্রী থাকে। কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাশকতা করে, সেটা প্রতিহত করা কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি।
ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন জানান, ১৩ অক্টোবর গাজীপুরে রেলে নাশকতার পর তারা ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ পুরো ঢাকা রেলওয়ে জেলায় ৫৫টি স্পট চিহ্নিত করেছেন। অনেকটা নির্জন ও দুর্গম এসব স্পটে রেলওয়ে পুলিশ অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করে রাত-দিন কাজ করছে।
তিনি বলেন, দুর্বৃত্তরা রেলযাত্রাকে অনিরাপদ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক আছে।
নাশকতার ঝুঁকি রয়েছে—এমন ৩০০ স্পট ঘিরে নিরাপত্তার বিষয়ে কর্মকর্তারা সরাসরি মুখ না খুললেও রেল পুলিশ ও রেল বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত এ স্পটগুলোর অবস্থান লোকালয়ের বাইরে। এসব রেললাইনের আশপাশে কোনো বসতি বা দোকানপাট নেই। নির্জন এলাকায় রেলপথে হেঁটে দায়িত্ব পালনের উদ্যোগ নিয়েছে রেল পুলিশ। এসব এলাকার অদূরে থাকা বাসিন্দাদের সতর্ক ও সচেতন করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে বিট পুলিশিং জোরদার করা হয়েছে। স্থানীয় থানা পুলিশও স্পট ধরে এলাকাবাসীকে সচেতন করছে। পাশাপাশি এসব স্পট এলাকায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহভাজন অনেকের ওপর করা হচ্ছে নজরদারি।
ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, তারা রেললাইনে দায়িত্বপালনকারী ওয়েম্যানদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন প্রতিনিয়ত। ওয়েম্যানরা তিন থেকে চারজন করে এলাকাভিত্তিক রেলপথে হেঁটে ২৪ ঘণ্টা ধরেই লাইনের নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এটা ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে। এখন তাদের বেশি সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়েছে।
বগিতে সিসি ক্যামেরা আর অগ্নিরোধক সরঞ্জাম চায় রেল পুলিশ: রেল পুলিশের একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, রেলে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করতে অনেক বেগ পেতে হয়। চলন্ত ট্রেনে পানির পর্যাপ্ততা না থাকায় আগুন লাগলে তা নেভাতেও সমস্যা হয়। এজন্য সম্প্রতি রেল পুলিশের পক্ষ থেকে চলন্ত ট্রেনের প্রতিটি বগিতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম চেয়ে রেল বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, একেকটা ট্রেনে ১৪ থেকে ২০টি বগি থাকে। জনবল স্বল্পতার কারণে পুরো ট্রেনে তাদের তিন থেকে চারজন সদস্য নিয়োজিত থাকে। ট্রেনে সিসি ক্যামেরা থাকলে কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে বা সন্দেহভাজনদের সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব।
জানতে চাইলে রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এ এম সালাহ উদ্দীন বলেন, প্রতিটি স্টেশনে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। বগিগুলোতেও অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা থাকে। তবে ট্রেনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের আলোচনা থাকলেও সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
নিরাপত্তায় চালু ‘অ্যাডভান্স পাইলট’ ব্যবস্থা: রেলে নাশকতা ঠেকাতে ‘অ্যাডভান্স পাইলট বা ট্রলি রান’ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরে নাশকতার পরদিন থেকে এ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে বলে রেল পুলিশ ও রেল বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রেলের একজন কর্মকর্তা জানান, ট্রেন ছাড়ার আগে একটি ইঞ্জিন বা ট্রলি গিয়ে রেললাইন ঠিক আছে কি না, তা দেখে নেয়। এটিই অ্যাডভান্স পাইলট সিস্টেম বা ট্রলি রান।
রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারা এবং ‘অ্যান্ডভান্স পাইলট সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা রেলওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, ট্রেন যাওয়ার আগে ট্রলি রান করানোর ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষকে পুলিশ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। নাশকতা ঠেকাতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাড়াতে গোয়েন্দা তথ্য ও নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
সম্প্রতি রেল বিভাগ সব স্টেশনে চিঠি দিয়ে ঢাকা-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-আখাউড়া, শায়েস্তাগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল-সিলেট, ময়মনসিংহ-শম্ভুগঞ্জ, গৌরীপুর-ময়মনসিংহ-শ্যামগঞ্জ, আখাউড়া-ভৈরব বাজার, টঙ্গী-ভৈরব বাজার, জয়দেবপুর-গফরগাঁও সেকশনে নিয়মিত প্যাট্রলিং করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
নাশকতায় বড় ক্ষতি কমাতে রাতে ট্রেনে ধীরগতি: রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাজীপুরের ঘটনার পর সতর্কতা হিসেবে রাতে চলাচলকারী ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে, ফেরার সময় ছাড়তেও দেরি হওয়ায় সব ট্রেনেরই সময়সূচি কিছুটা নড়বড় হয়েছে।
রেলের একজন কর্মকর্তা জানান, গত বৃহস্পতিবার রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের চিফ অপারেটিং অফিসারের কার্যালয় থেকে রেলের বিভিন্ন দপ্তরে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়, ‘চলমান বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরাপদ ট্রেন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন রুটের ট্র্যাক প্যাট্রলিং করতে হবে। এ ছাড়া রাত ১১টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ট্রেনগুলো ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে চালাতে হবে।’ যদিও আন্তঃনগর ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটার গতিতে চলে।
গত ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুরে দুর্বৃত্তরা রেললাইন কেটে রাখায় ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে একজন প্রাণ হারান ও ১০ জন আহত হন। এ ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিএনপিপন্থি একজন কাউন্সিলরসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই রাতেই নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলে নাশকতার চেষ্টা হয়। এ ছাড়া গতকাল বিকেলে কুড়িগ্রাম-রংপুর রেললাইনের ঠাঁটমারী এলাকার রেল সেতু থেকে ১০টি হুক খুলে ফেলার তথ্য দেয় রেল বিভাগ।
এর আগে ১৫ নভেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের গাজীপুর অংশে দুর্বৃত্তরা অগ্নিসংযোগ করে। ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে লোহার মোটা ভারী পাত রেখে নাটবোল্ট লাগিয়ে ট্রেন আটকে নাশকতার চেষ্টা চালানো হয়।