জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি ভাঙার প্রতিযোগিতা যেন ততই বাড়ছে। অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে সহিংসতা-সংঘাত হচ্ছে। এই ডামাডোলের মধ্যে নির্বাচন ‘ঠেকাতে’ চলছে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো নাশকতা। আন্দোলনরত বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে যানবাহন ও স্থাপনায় আগুন দেওয়া হচ্ছে, চলছে ককটেলবাজিও। এমন পরিস্থিতিতে দুই ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে পুলিশ।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনী পরিবেশ শান্ত রাখতে সারা দেশে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। রাস্তাঘাট দখল করে যাতে প্রচার না হয়, যে কোনো ধরনের জনভোগান্তি যাতে না হয়, প্রার্থীদের এই নির্বাচনী আচরণবিধি মানাতে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এর পরও প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এই সংঘর্ষ যাতে না হয় এবং তা হয়ে গেলে মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তারেও সময় দিতে হচ্ছে। প্রতিদিনের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এর বাইরে নির্বাচন বানচাল করতে নানা নাশকতা চালানো হচ্ছে। এই নাশকতা ঠেকানো এবং নাশকতাকারীদের আইনের আওতায় নিতে কাজ করতে হচ্ছে পুলিশকে। বড় ধরনের নাশকতা ঠেকাতেও সতর্ক থাকতে হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে একসঙ্গে এ দুই দায়িত্ব পালন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নেওয়া হয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ উতরে যাওয়ার সক্ষমতা পুলিশ বাহিনীর রয়েছে।
নির্বাচন আচরণবিধি মানানো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে চলেছে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা ও আশপাশের এলাকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘অন্যান্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পুলিশ, অন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্টেকহোল্ডারদের একমুখী সমস্যা থাকে—সেটা হলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের আচরণবিধি মানতে বাধ্য করা এবং নির্বাচনে সহিংসতাপূর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে সুষ্ঠু ভোট আয়োজন করা। এবারের জাতীয় নির্বাচনে আরেকটি অতিরিক্ত বিষয় যুক্ত হয়েছে, সেটি হচ্ছে—নাশকতা, আতঙ্ক ও শঙ্কা সৃষ্টি করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’
অবশ্য তিনি বলেন, ‘এসব সমস্যা ও শঙ্কা মোকাবিলা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে তোলার মতো অবস্থান এবং সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং নির্বাচনী পরিবেশ ধরে রাখতে করণীয় সম্পর্কে পুলিশের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পাশাপাশি মানুষের জানমাল রক্ষায় যে কোনো ধরনের অপতৎপরতা বন্ধেও পুলিশ বদ্ধপরিকর এবং সেই অভিজ্ঞতাও রয়েছে। যে কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাই পুলিশের কাজ।
পুলিশ সদর দপ্তরের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব কাজই চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকে। প্রশিক্ষিত বাহিনী হিসেবে সেই চ্যালেঞ্জ পার হওয়ার মতো কৌশলও জানা থাকে। এজন্যই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি জ্বালাও-পোড়াওয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
একাধিক জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রত্যেক প্রার্থীকে সমানভাবে মূল্যায়ন করছে পুলিশ। নির্বাচনী পরিবেশ নষ্ট করার অনেক চেষ্টা যেমন আগাম মোকাবিলা করা হচ্ছে, তেমনি কেউ পরিস্থিতি খারাপ করলে, সংঘর্ষ-সংঘাতে জড়ালে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এসব ঘটনায় মামলা হচ্ছে। সেই মামলার তদন্ত এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অনেক সময় যাচ্ছে। আবার নাশকতা ঠেকাতেও রাত-দিন পুলিশ সতর্ক রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সবার ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।
ঢাকা রেঞ্জের একটি জেলার পুলিশ সুপার বলেন, নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণ হয়, কোনো সহিংসতা যাতে না হয়, সে ধরনের বার্তা মাঠ প্রশাসনে রয়েছে। প্রার্থীদের কোনো সমর্থক বা কোনো গোষ্ঠী পরিবেশ যেন নষ্ট করতে না পারে, তৃতীয় পক্ষ যাতে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, নির্বাচনে বাধা দেওয়ার চেষ্টার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেদিকে ব্যস্ত আছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে তো সেটা হতো না। বিভিন্ন জায়গায় বাসে আগুন দিচ্ছে, রেললাইন কেটে দিচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো ওইসব দিকে সময় দিচ্ছে। বিএনপি ভোটে এলে এ সময়টা তো তাদের দিতে হতো না। তারা ভোটের ব্যবস্থাপনায় সময় দিতে পারত।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক কালবেলাকে বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে পুলিশ যেমন দায়িত্ব পালন করছে, এই পরিবেশ যারা নষ্ট করতে জ্বালাও-পোড়াও করছে, তাদেরও আইনের আওতায় নিতে পুলিশ কাজ করছে। জাতীয় নির্বাচনে নানা নাশকতা একটি চ্যালেঞ্জ হলেও তা মোকাবিলা করার মতো পুরো সক্ষমতা পুলিশের রয়েছে। সে প্রমাণ নানা সময়ে এ বাহিনী দিয়েছে।