দ্বাদশ সংসদ বাতিল, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও যুগপতের মিত্ররা। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে চলতি মাসেই ঢাকাসহ সব সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশ আয়োজনের চিন্তা করা হচ্ছে। আগামী ৩০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনের আগেই আসতে পারে এ কর্মসূচি। আর অধিবেশনের শুরুর দিন হরতাল-অবরোধ কিংবা সংসদ ভবন ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও দিতে পারে বিএনপি। সরকারবিরোধী এসব কর্মসূচির পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যসহ জনসম্পৃক্ত বিভিন্ন ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার জন্য যুগপতের মিত্ররা বিএনপিকে তাগিদ দিচ্ছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে যুগপৎ কর্মসূচির তাগিদ দিচ্ছে বিএনপির মিত্র কয়েকটি দল। কেউ কেউ এসব ইস্যুতে নিজেদের মতো কর্মসূচি নিয়ে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেও পড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার দাবিতে গত শুক্রবার রাজধানীতে গণবিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে ঢাকা মহানগর গণঅধিকার পরিষদ। এ ছাড়া আগামীকাল সোমবার ঢাকায় মানববন্ধন করবে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। একই দাবিতে ১২ দলীয় জোটও শিগগির কর্মসূচি দেবে। বিএনপিও আসন্ন বিভাগীয় সমাবেশে রমজান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি জোরালোভাবে অন্তর্ভুক্ত করবে।
জানা গেছে, বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চ এখনো আন্দোলনে নিজেদের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব কষছে। এর অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরায় জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রবের বাসায় দ্বিতীয় মূল্যায়ন বৈঠক করে যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ এই জোট। সেখানে জোটগতভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের ভবিষ্যৎ করণীয়সহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সপ্তাহখানেক আগে প্রথম মূল্যায়ন বৈঠক হয়। আগামী ৩১ জানুয়ারি মঞ্চের পরবর্তী মূল্যায়ন বৈঠক হবে।
নেতাদের মূল্যায়ন, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র মঞ্চও সাংগঠনিক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থেকেছে। বিশেষ করে হরতাল-অবরোধের সময় গ্রেপ্তারের শঙ্কা সত্ত্বেও রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নির্বাচনে যেতে সরকারের নানামুখী চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও প্রধান শরিক বিএনপির সঙ্গে তারা বেইমানি করেনি। বরং সরকারবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে এবং একতরফা নির্বাচনের বিরুদ্ধে সরব থেকেছে। এতে করে গণতন্ত্র মঞ্চকে ঘিরে মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে, যা তাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করছে। তাই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকার পাশাপাশি আগামীতে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাচনী শক্তি হিসেবেও আবির্ভূত হতে চায় ছয়দলীয় এই জোট। এ লক্ষ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এখন থেকে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়েও গুরুত্ব দিতে চায় গণতন্ত্র মঞ্চ। ছয়দলীয় এই জোট মনে করে, শুধু সংসদ বাতিল এবং একদফার আন্দোলনে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সম্ভব নয়। এজন্য জনস্বার্থ ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি দিতে হবে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিজুড়ে দেশের আট বিভাগীয় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে প্রতিনিধি সভা অথবা কর্মিসভা এবং গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। দ্বাদশ সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে করণীয় নির্ধারণে এই কর্মসূচি পালিত হবে।
এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে প্রণীত ৩১ দফার সংস্কার চায় গণতন্ত্র মঞ্চ। রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের এই রূপরেখায় জনজীবনের দুর্ভোগ লাঘবের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে যুগপতের শরিক ছয়দলীয় এই জোট। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রধানমন্ত্রী পদের জবাবদিহিও চান তারা। এ ছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কারসহ আরও একাধিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে তাদের। এর আগে আলোচনার ভিত্তিতে ৩১ দফা প্রণীত হলেও ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে তখন পুরোপুরি মতৈক্য হয়নি। মঞ্চের বৈঠকে ৩১ দফার মূল স্পিরিটকে নতুন করে সামনে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর আগে গত ১৩ জানুয়ারি বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকেও ৩১ দফা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে মঞ্চের নেতারা বলেন, সরকার ও সরকারি দল দীর্ঘদিন ধরে যুগপৎ আন্দোলনকে জ্বালাও-পোড়াওয়ের আন্দোলন, আন্দোলনের কোনো লক্ষ্য না থাকা, ক্ষমতাসীন হলে মানুষের জন্য কোনো ভিশন না থাকা এবং বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করতে ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য দিয়ে আসছে। অথচ ৩১ দফায় যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্য ও ভিশনের কথা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে; কিন্তু এটাকে আমরা দেশে-বিদেশে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। তাই ওই বৈঠকে ৩১ দফা রূপরেখাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে আগামী ৩০ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর দিন ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ এই জোট। সংসদ বাতিল, একদফা দাবি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে এই কর্মসূচি করবে গণতন্ত্র মঞ্চ।
জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন কালবেলাকে বলেন, ‘ আমরা বিশ্বাস করি, যুগপৎ আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে রাজপথে সক্রিয়তা, সরকারবিরোধী অবস্থানে সরব থাকাসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চকে ঘিরে সারা দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হয়েছে। এর ওপর ভর করে আগামীতে গণতন্ত্র মঞ্চের কার্যক্রম সারা দেশে বিস্তৃত করতে চাই। বিকল্প কর্মসূচি দিয়ে আমরা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাই। একই সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চকে আমরা নির্বাচনী শক্তি হিসেবেও গড়ে তুলতে চাই। তাই আমরা মনে করি, সংসদ বাতিল এবং একদফার আন্দোলনের সঙ্গে জনস্বার্থ ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে মাঠে সক্রিয় থাকা দরকার। তিনি বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ একদফার আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সংস্কার কর্মসূচিকেও জনগণের সামনে তুলে ধরতে চায়।’
গণতন্ত্র মঞ্চের মতো যুগপৎ আন্দোলনের অন্য শরিকরাও আগামীতে জনস্বার্থ ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মসূচি প্রণয়নের পক্ষে। তাদের অভিমত, আন্দোলন সফল হতে হলে কর্মসূচিতে জনগণকে ব্যাপক হারে সম্পৃক্ত করতে হবে।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘জনদাবি উপেক্ষা করে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রহসনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ভোট বর্জন করায় এই সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। এদের বিদায়ের লক্ষ্যে আমরা শিগগির কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামব। এ ক্ষেত্রে সংসদ বাতিল এবং একদফার পাশাপাশি জনস্বার্থ ইস্যুও গুরুত্ব পাবে।’
একই অভিমত জানিয়েছেন গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ এবং ১২ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক রাশেদ প্রধানও।