ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ৭টি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব ব্যাংকের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। করপোরেট সুশাসন এবং ব্যাংকিং ব্যবসার ভিত্তি মজবুত না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক মিলিয়ে মোট ৭টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। তবে কিছু ব্যাংক প্রভিশন উদ্বৃত্ত রাখায় দেশের ব্যাংক খাতে সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতের সার্বিক প্রভিশন ঘাটতি ছিল ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি কমেছে ৬ হাজার ১০ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে রাখতে হয়। নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ আর সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ অর্থ জমা রাখতে হয়। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসানি ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে। তবে আর্থিক দুর্বলতার কারণে অনেক ব্যাংকই এই শর্ত পূরণ করতে পারে না। অর্থাৎ প্রভিশন রাখার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই। এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত। কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি হয়ে পড়ার ফল।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঋণে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দেশে আর্থিক সংকট থাকার কারণে বর্তমানে আমানতের প্রবৃদ্ধি তেমন একটা নেই। পাশাপাশি ব্যাংকে তারল্য সংকটও আছে। এই কারণে হয়তো ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না।’
তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৩ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি ১ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত বেসিক ব্যাংক। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আরেক রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংক। এই সময়ে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রায়াত্ত রূপালী ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৮৫ কোটি, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩১ কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। এই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ১১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ।