বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডি-ব্লকের তিনতলায় শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের জটলা। চার বছরের শিশু লাবিবকে নিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে এসেছেন মা হুসনে আরা। থাকছেন ফ্লোরে চাটাই পেতে। লাবিব প্রথমে জ্বরে আক্রান্ত হয়। সাধারণ জ্বর ভেবে মা-বাবা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ান। কিন্তু থেমে থেমে জ্বর আসতে থাকে। কয়েক দিন না যেতেই গলার নিচের অংশ ফুলে যায়। অবশেষে চিকিৎসকের কাছে যান লাবিবের
বাবা-মা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্থানীয় চিকিৎসক পরামর্শ দেন ঢাকায় নেওয়ার। ঢাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে আরেক দফা পরীক্ষা করিয়ে শনাক্ত হয় লাবিব রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। এরপর থেকে সন্তানকে নিয়ে হুসনে আরা নিয়মিত আসছেন বিএসএমএমইউতে। কয়েক দফা চিকিৎসা গ্রহণের পর লাবিবের অবস্থা এখন সুস্থতার পথে।
শুধু লাবিবের মায়ের মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সন্তান নিয়ে এসেছেন অভিভাবকরা। কারও প্রথম চিকিৎসা কিংবা ফলোআপ হচ্ছে বিএসএমএমইউর ডি-ব্লকে শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে। গত শনিবার বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগে কথা হয় হুসনে আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই মাস হলো ছেলের ক্যান্সার শনাক্ত হলো। চিকিৎসকরা বলছেন, এখন অনেকটাই সুস্থ আছে। আর কিছুদিন গেলে ছেলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
শিশুদের ক্যান্সার আক্রান্ত নিয়ে সচেতনতার লক্ষ্যে আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশু ক্যান্সার দিবস। ২০০২ সালে চাইল্ড ক্যান্সার ইন্টারন্যাশনালের (সিসিআই) উদ্যোগে দিবসটি পালন শুরু হয়। সচেতনতা সৃষ্টি ছাড়াও এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য হলো শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করা এবং ক্যান্সারজনিত ব্যথা ও এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা শিশুদের দুর্দশা হ্রাস করা।
ওয়ার্ল্ড চাইল্ড ক্যান্সারের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর চার লাখ শিশু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর এর মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশগুলোতেই মোট সংখ্যার ৮০ শতাংশ শিশু আক্রান্ত। এসব দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের বেঁচে থাকার হার মাত্র ৫ শতাংশ। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোয় এ হার ৮০ শতাংশ। সংস্থাটির তথ্যমতে, বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত শিশু রয়েছে। প্রতি বছর শনাক্ত হয় অন্তত ৬ থেকে ৮ হাজার। ২০০৫ সালেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সচেতন না হলে ২০৩০ সালে এ হার দাঁড়াবে ১৩ শতাংশে।
বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগের তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিশুদের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারের সংখ্যাই বেশি। তবে শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার ছাড়াও ব্রেইন টিউমার, নিউরোব্লাস্টোমা, চোখের টিউমার বা রেটিনোব্লাস্টোমা, যকৃতের টিউমার বা হেপাটোব্লাস্টোমা, কিডনির টিউমার বা নেফ্রোব্লাস্টোমা, হাড়ের টিউমার বা অস্টিওসারকোমা, মাংসপেশির টিউমারসহ আরও বিভিন্ন রকম ক্যান্সার প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে। চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক অনকোলজি বিভাগে। আরও সাতটি প্রতিষ্ঠানে শিশু ক্যান্সার বিভাগ থাকলেও সেবা নেই।
২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসএমএমইউ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া চার হাজার ৫২৬ জন শিশু রোগীর ওপর জরিপ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি অ্যান্ড অনকোলজি বিভাগ। এতে দেখা যায়, শনাক্তের ৩ হাজার ৬৫০ জন, অর্থাৎ ৮০ শতাংশ রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। টিউমারজনিত ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিল ৩৫৩ জন বা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যান্সারে ৫২৩ জন বা ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে অ্যাকিউট লিম্ফোব্লাস্টিক লিউকেমিয়ায় ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ; অ্যাকিউট মায়েলয়েড লিউকোমিয়ায় ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নন-হজকিন্স লিম্ফোমায় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আক্রান্ত ছিল। এর পরে আর এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের বিষয়ে কোনো জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জেনিটিক্যাল কারণ, ভাইরাস, খাবারে টক্সিনের উপস্থিতি, কেমিক্যালস, পরিবেশগত সমস্যায় শিশুদের ক্যান্সার হয়। ব্লাড ক্যান্সারের পাশাপাশি নসিকাগ্রন্থি, কিডনি এবং চোখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে দেখা যায় শিশুদের। তবে আশার কথা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে এ রোগ শনাক্ত করা গেলে বেশিরভাগ শিশুরই ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা নিলে ৯৫ শতাংশ শিশু রোগীর ক্যান্সার নির্মূল করা সম্ভব।
তারা আরও বলছেন, শিশু রোগীদের ৮০ শতাংশই রক্তের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যায়নি। এখনো অনেকে ঝাড়-ফুঁক বা কবিরাজি চিকিৎসা নিয়ে থাকে। শিশুদের ক্যান্সার মোকাবিলায় সবার আগে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শিশুদের সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার, যেমন—পালং শাক, ব্রকোলি, ডিমের কুসুম, মটরশুঁটি, কলিজা, মুরগির মাংস, কচুশাক, কলা, মিষ্টি আলু, কমলা, শালগম, দুধ, বাঁধাকপি, বরবটি, কাঠবাদামের মতো ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুদের ক্যান্সার শনাক্তের হার বাড়লেও সে অনুযায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও কম। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৫৫ জনের মতো ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। অভিজ্ঞ নার্স ও টেকনিশিয়ান এবং ঢাকার বাইরে শিশু ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা এখনো অপ্রতুল।
বিএসএমএমইউর শিশু হেমাটোলজি ও অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান বলেন, শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্তের ঝুঁকিপূর্ণ সময় ধরা হয়। শব্দ, বায়ু পানিদূষণ, অতিরিক্ত নগরায়ণ, বিভিন্ন প্রযুক্তি ও ডিভাইসে আসক্তি শিশুদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ছে। ব্লাড ক্যান্সার প্রতিরোধে এসব অবস্থার উন্নতি এবং অপ্রয়োজনীয় ডিভাইস থেকে শিশুদের ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ছে।
তিনি বলেন, শরীরে ব্যথা, ফোলা ভাব, অনেক দিন ধরে জ্বর, মাথা ব্যথা বা মাথা ঘোরা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, ক্লান্তি ও স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি ঘাম, হঠাৎ রক্তপাত এগুলো হলো ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ।