পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ থাকলেও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প। এমনকি নির্ধারিত সময়ের ৩ থেকে ৫ বছর পরও শুরু হয়নি অনেক প্রকল্পের কাজ। আবার ১০ বছরে কোনো কোনোটির কাজ এগিয়েছে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ। বিদ্যুৎ উন্নয়নে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে এমন কচ্ছপগতি ‘হতাশাব্যঞ্জক’ বলে মন্তব্য করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
বিদ্যুৎ খাতের ৬৭টি প্রকল্পের ওপর সম্প্রতি একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। সেখানেই উঠে এসেছে এমন হতাশার চিত্র। প্রতিবেদনে আইএমইডি বলছে, বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। ক্ষেত্র বিশেষে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ৩ গুণ বেশি সময় লাগে। এতে একদিকে যেমন ব্যয় বাড়ে, তেমনি সঠিক সময়ে এর সুফল পায় না সাধারণ মানুষ। সমীক্ষার দুর্বলতা, যথাযথ পরিকল্পনার
অভাব, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন ধীরগতি বলে মনে করে আইএমইডি।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) বাস্তবায়নাধীন ১২টি প্রকল্পের মধ্যে ৭টিরই কাজের সময়কাল ৭ থেকে ৯ বছর পার হয়েছে। এ সময়ে প্রকল্পগুলোর কাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে গড়ে ৭৪ শতাংশ। এসব প্রকল্পে গড়ে বরাদ্দ মোট অর্থের ৬৪ দশমিক ৪১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।
পিডিবির প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি শুরু হয়েছিল ১০ বছরের বেশি সময় আগে। এটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি যথাক্রমে ১৬ ও ৩০ শতাংশের সামান্য বেশি। সংস্থাটির ১৭ শতাংশ প্রকল্পের মেয়াদকাল ৪ থেকে ৬ বছর অতিক্রান্ত হলেও গড়ে আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি যথাক্রমে ৫৬ এবং ৬৬ শতাংশের সামান্য বেশি।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) ৬টি প্রকল্প ৪ থেকে ৬ বছর ধরে চলমান থাকলেও গড় আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি যথাক্রমে ৪২ ও ৪৮ শতাংশ।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৮টির কাজ চলছে ৭ থেকে ৯ বছর ধরে। কিন্তু গড় আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি যথাক্রমে ৪২ ও ৫১ শতাংশ। অন্যদিকে ৬টি প্রকল্পে বাস্তবায়নের সময় ৪ থেকে ৬ বছর পার হলেও আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি যথাক্রমে ৪৮ ও ৫০ শতাংশ।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৩টির বাস্তবায়নকাল ইতোমধ্যে ৪ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এগুলোরও আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতির গড় ৪০ ও ২৭ শতাংশ। এসব প্রকল্পে কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদাররা বিল তুলে নিয়েছেন। এ কারণে অর্থ ব্যয়ের হার বেশি হলেও বাস্তব কাজের অগ্রগতি খুবই কম। আবার একটি প্রকল্পে ১০ বছর পার হলেও আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে যথাক্রমে ১৮ ও ২৩ শতাংশ।
ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) কাজের অবস্থা আরও শোচনীয়। এ সংস্থাটির ৩টি প্রকল্প ৪ থেকে ৬ বছরে ধরে চলমান থাকলেও গড় আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ২ ও ৫ শতাংশ। আর পাওয়ার সেলের প্রকল্প শুরুর চার বছর পর আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ১৩ ও ৩০ শতাংশ।
ওজোপাডিকোর চলমান ৪টি প্রকল্পের মধ্যে দুটির মেয়াদকাল ৪ থেকে ৬ বছর। বাকি দুটির ৭ থেকে ৯ বছর। কোনোটির বাস্তবায়ন অগ্রগতিই আশানুরূপ নয়। নওপাজকোর ক্ষেত্রেও অবস্থা একই রকম।
৪ বছর পার হলেও ইজিসিবির একটি প্রকল্পের আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ৭০ ও ২৯ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রকল্পে কাজের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন ঠিকাদার। এসপিসিএল, সিপিজিসিবিএ ও স্রেডার প্রকল্পগুলোর অবস্থাও একই রকম। আরপিসিএলের দুই প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি একবারেই সামান্য।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) অবস্থা আরও খারাপ। চারটির মধ্যে দুটি প্রকল্প এখনো আলোর মুখ দেখেনি। ৪ থেকে ৬ বছর পার হলেও অন্যগুলোর বাস্তবায়ন হার উল্লেখ করার মতো নয়।
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতিতে হতাশা ব্যক্ত করে আইএমইডি বলছে, মাঠপর্যায়ে সমীক্ষা না করে এবং প্রকল্প দপ্তরের অদক্ষতার কারণেও প্রকল্পের কাজের গতি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে প্রতিবেদনে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় পিডিবির অফ গ্রিড এলাকায় বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে তেলনির্ভর হাইব্রিড বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়। বাস্তবসম্মত না হওয়ায় মূল কাজ না করেই প্রকল্প গ্রহণের চার বছর পর বাতিল করা হয়েছে এটির কাজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করা একটা কৌশল। এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় তিন-চারগুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের যেসব কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত, এর মাধ্যমে তারা নিজেরা লাভবান হয়, ঠিকাদারদের লাভবান করে। যারা এভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতি করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
মন্তব্য করুন