ট্রেনের জন্য চীন থেকে গত এক বছরের মধ্যে ১০০ কোচ কিনেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চীনের কোম্পানি সিআরআরসি থাংশান থেকে কেনা এসব কোচ ট্রেনে যুক্ত করার পরপরই ১২ থেকে ১৫ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। অথচ এসব কোচ আনা হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগেই। ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-খুলনা, বেনাপোল-খুলনা এবং ঢাকা-চিলাহাটি রুটে চলাচল করা এসব কোচ ট্রেনে যুক্ত করার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই চাকা ক্ষয়ে যাচ্ছে কিংবা বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ফলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিআরআরসির প্রতিনিধিদের দফায় দফায় মিটিং হলেও সমস্যার সমাধান মিলছে না। দিন দিন কোচের সমস্যা আরও বাড়ছে। কোচগুলো নিম্নমানের দাবি করে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকের কাছে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানান, এসব কোচ পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় কেনা হয়েছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে পদ্মা সেতুতে এখনো পুরোপুরি সব ট্রেন চলছে না। এজন্য এসব কোচ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রডগেজে চলা এসব কোচের প্রতিটির দাম প্রায় ৭ কোটি টাকা। নানা সমস্যায় জর্জরিত এসব কোচের যাত্রীরা সেবা নিয়ে খুবই বিরক্ত।
যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত অনুসন্ধানে জানা গেছে, চীনের নতুন কোচগুলোতে ১২ থেকে ১৫ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সমস্যাগুলো হলো—১. চাকা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্ষয় হচ্ছে। হুইল স্কিডেড হয়ে যাচ্ছে। ফলে যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। ২. চলন্ত অবস্থায় ব্রেক প্যাড পড়ে যাচ্ছে। ৩. রানিংয়ে এক্সেল কয়েল স্প্রিং ভেঙে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে নতুন কোচের স্প্রিং দুই থেকে তিন বছর পরে ভাঙে। ৪. প্রাইমারি ডাম্পার অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অস্বাভাবিকভাবে অয়েল লিকেজ হচ্ছে। ৫. এন্টিফেটিক বোল্ট খুলে পড়ে যাচ্ছে। ৬. ফোর বোল্ট, হুইল সেট গাইড লুজ বা ড্রপিং হচ্ছে। ৭. কোচের রুফ সিলিং খুলে যাচ্ছে এবং দরজা বরাবর ওপরের রুফ সিলিং নিচে নেমে যাচ্ছে। ৮. ডব্লিউজেসি টাইপ কোচের কেবিনের দরজার লক ঠিকমতো কাজ করছে না। ৯. টয়লেটের ফ্ল্যাশ কাজ করছে না। ১০. পানির ট্যাঙ্ক ভরা থাকলেও হ্যান্ড শাওয়ারে ও পানির কলে পানির প্রেশার নেই। ১১. প্রতিনিয়ত জানালার স্যুট বোল্ট খুলে যায়। ১২. বায়ো টয়লেটের ডেলিভারি লাইন দিয়ে যে সর্বদা মল ও নোংরা পানি পড়ে, সেখানে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ১৩. ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ১৪. দ্রুত পাওয়ার কার গরম হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ইঞ্জিন থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।
রেলওয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, সমস্যাগুলো বেশি বড় নয়। কিন্তু ছোট ছোট এসব সমস্যা আমাদের খুবই ভোগান্তিতে রেখেছে। আমরা চেষ্টা করছি সমাধানের। তিনি বলেন, কোচগুলো দুই বছরের ওয়ারেন্টিতে কেনা হয়েছে। কোচেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমরা সিআরআরসির প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। তাদের জানিয়েছি। তারা কিছু কিছু সমস্যার সমাধান দিয়েছে। তবে এত অল্প সময়ের মধ্যে কোচগুলোতে সমস্যা দেখা দেবে তা আমরা চিন্তাও করিনি। সমস্যাগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে আরও চিহ্নিত এবং নিয়মিত মনিটরিং করছি।
সূত্র জানায়, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে চীনের কোম্পানি সিআরআরসি থেকে কয়েক মাস আগে ১০০টি কোচ কেনে বাংলাদেশ রেলওয়ে। কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী এসব কোচের ওয়ারেন্টি দুই বছরের। কিন্তু কোচগুলো ট্রেনে যুক্ত করার পরপরই নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। অথচ ইন্দোনেশিয়া এবং ভারত থেকে আনা রেলের কোচ গত ছয়-সাত বছর ধরে কোনো ধরনের সমস্যা ছাড়াই চলাচল করছে।
ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমস্যার কথা স্বীকার করে কালবেলাকে বলেন, ‘কোচগুলো এক বছরের কম সময় কেনা হয়েছে। অথচ এখনই সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে আমরা সবাই ক্ষুব্ধ।’
রেলওয়ের সৈয়দপুর সিঅ্যান্ডডব্লিউ মেশিন শপ সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিজি এমডি-৫২৩ (চায়না-২০২৩) ১০০টি কোচ রোলিং স্টকে যুক্ত হয়। এ কোচগুলো নিয়মমাফিক প্রতি এক বছর পরপর শিডিউলি মেরামতে আসার কথা থাকলেও চাকার বিভিন্ন ত্রুটিজনিত কারণে এক বছরের আগেই স্পেশাল রিপেয়ারের প্রয়োজন পড়ে। এসব কোচ বিভিন্ন সময় সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় মেরামতে এলে চাকা টার্নিংয়ের সময় চাকায় ব্লোহোল বা ক্রাক দেখা যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে ৮ মিমি থেকে ১০ মিমি চাকা টার্নিংয়ের প্রয়োজন হয়। তার তুলনায় ব্লোহোল বা ক্রাকের কারণে অনেক বেশি ১৫ মিমি থেকে ২০ মিমি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি টার্নিংয়ের প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে চাকার স্থায়িত্বকাল আগের চেয়ে অনেক কমে যাচ্ছে।
গত ৪ মার্চ দুপুরে নিজ দপ্তরে বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) পার্থ সরকারের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি কিছুটা রাগান্বিত হয়েই বলেন, ‘চায়না থেকে কেনা কোচের কোনো সমস্যাই আমার চোখে পড়েনি। আমি প্রতিদিন আমার বাসা থেকে এসব কোচ দেখতে পাই। কই, আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না! আপনি কীভাবে জানলেন কোচে সমস্যা? আপনি সমস্যা দেখতে পেলে পত্রিকায় লিখে দেন। রিপোর্ট করে দেন।’
কথা বলার জন্য পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আফজাল হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। ফলে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসানকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।