মাদক মামলার এক আসামিকে জামিন দেননি হাইকোর্ট। অথচ জামিন হয়েছে উল্লেখ করে হাইকোর্টের এক ‘গায়েবি’ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলকে ‘নোট’ দিয়েছেন একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি)। সেই নোটের ভিত্তিতে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। আবেদনের ভিত্তিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালত হাইকোর্টের সেই ‘গায়েবি’ আদেশের কার্যকারিতার ওপর দিয়েছেন স্থগিতাদেশ। বিষয়টি ধরা পড়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করেন।
হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট আইন কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন, ‘আমরাও তো মানুষ। আপনার এমন কর্মকাণ্ডে আমাদেরও হৃদয় ভেঙে যায়।’ রাষ্ট্রের সেই আইন কর্মকর্তা ডিএজি সাইফুদ্দিন খালেদের কাছে এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে ব্যাখ্যা চান আদালত। ঈদুল ফিতরের পর ‘গায়েবি’ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার জন্য কেন নোট দিয়েছেন, তাকে এর ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মাদকের মামলায় হাইকোর্টে জামিন চেয়েছিলেন কক্সবাজারের এমরান নামে এক আসামি। গত ১১ মার্চ জামিন আবেদনটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের কার্যতালিকায় ছিল। তবে সেদিন শুনানি ও আদেশ হয়নি। কিন্তু শুনানি ও আদেশ না হলেও এই আসামির জামিন হয়েছে মর্মে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকে নোট দেন ডিএজি খালেদ। ওই নোটের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গায়েবি’ জামিন আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে যায় রাষ্ট্রপক্ষ।
বিষয়টি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নজরে আসার পর গতকাল দুপুরের বিরতির পর এজলাসে আসেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেন। আসন গ্রহণের পর ডায়াসে ডেকে নেন ওই আইন কর্মকর্তাকে। ডিএজি খালেদের উদ্দেশে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘ইমরান বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় আমরা তো আসামিকে জামিন দিইনি। অথচ আপিল বিভাগ থেকে জামিন আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলকে কীভাবে আপনি এত বড় ভুল তথ্য দিলেন। এই কর্মকাণ্ডের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। আপনি যেভাবে নোট দিয়েছেন, সেভাবে পরবর্তী প্রক্রিয়া এগিয়েছে। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের কোনো দায় দেখছি না।
এ পর্যায়ে সাইফুদ্দিন খালেদ বলেন, ‘কার্যতালিকার পূর্বের মামলার জামিন আদেশের বিষয়টি ভুল করে এই মামলায় মার্ক করেছি। এ কারণে আমার এই ভুল হয়েছে।’ বিচারপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে আদেশ দিইনি, সেটা কীভাবে স্থগিতের জন্য আপিল বিভাগে যেতে পারেন। ৩৪ বছর ধরে সুপ্রিম কোর্টে আছি। সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। কেউ কোনোদিন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। অথচ একজন আইন কর্মকর্তা হয়ে একটা অসত্য তথ্য দিয়ে কোর্টকে হেয় করলেন। কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করলেন। এটার জবাবদিহি আপনাকে করতে হবে।’ এ সময় ওই আইন কর্মকর্তা ডায়াসের সামনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
তখন বিচারপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সম্মানের জন্য বিচারপতির আসনে আছি। সম্মান যদি না থাকে, তাহলে কীসের বিচার কাজ? আপনার একটা অসত্য তথ্যে টিভি চ্যানেলগুলোতে আমাদের নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার হলো। আমি তো রাতে ঘুমাতে পারিনি। অথচ আমরা ওই মামলার শুনানিই করিনি, আদেশ তো দূরের কথা।’ বিচারপতি আরও বলেন, ‘সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করেছি। এখন পর্যন্ত কোনো দুর্নীতি আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অথচ আমাদের নিয়ে একটা অসত্য তথ্য প্রচার হলো। এর দায় কে নেবে? আপনি (ডিএজি) তো আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন।’
ডিএজি খালেদের উদ্দেশে বিচারপতি নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ডিএজি থেকে বিচারপতি হয়। আপনারও বিচারপতি হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু আপনি একটা কোর্ট সম্পর্কে কেন এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিলেন? আপনার কর্মকাণ্ডে বিচার বিভাগ হুমকির মুখে পড়েছে। এটা তো কোনো ছেলে খেলা নয়। এটা কোনো ফানি গেম নয়। আপনি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন। যদি সন্তুষ্ট না হই, তখন লিখিত আদেশ দেব।’