জীবনে সত্তরের অধিক ঈদ পেরিয়ে—এত বছর পরে এসে পেছনের দিকে যখন তাকাই, দেখি যে জীবনে অনেক ঈদ ছিল যেগুলো খুবই সাধারণ। কিছু ঈদ ছিল বিচিত্র। সবার জীবনেই কিছু ঈদের এমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে। সবচেয়ে আলাদা।
এ বয়সে এসে উৎসব আয়োজনের প্রতি আবেদন অবশ্যই আর আগের মতো থাকে না। তবে ঈদে-উৎসবে বাচ্চাদের দেখতে খুব ভালো লাগে। কারণ তারা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়, ওই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি কিন্তু যাচ্ছি না। আমার এখনকার ঈদ তো হলো, বয়স্ক বাবার ঈদ। সে হিসেবে আমার ঈদে সবার আগে ভাবতে হবে ছেলেমেয়েদের জন্য কী কিনতে হবে, স্ত্রীর জন্য কী কিনতে হবে—সেই টাকাটা পাওয়া যাবে কি না, কোন জায়গায় কত খরচ করা যাবে ইত্যাদি। আমার মনে হয় এখনকার ঈদের আয়োজনটার অনেকটা বিসামাজিকীকরণ হয়ে গেছে। আমরা আগে ঈদটা কিন্তু এককভাবে করতাম না। ঈদ আগে এতটা পরিবারভিত্তিক ছিল না। আগে ঈদে পুরো সমাজেরই সাড়া পাওয়া যেত। এখন ঈদ অনেকটা উপভোগের, তখন ছিল উদযাপনের ঈদ। তখন পারিবারিকভাবেও অনেকে অনেকের সঙ্গে মিশত। আমার মনে আছে, সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা ছিল—যখন আমার মামারা আসত। সবাই মিলে খাবার জন্য কাবাব, টিকিয়া, সেমাই ইত্যাদির আয়োজন থাকত। অর্থাৎ যে মজাটা লাগত, সেটা সবার জন্য মজা। এ ব্যাপারটা এখন আর সম্ভব নয়।
ঢাকায় বা বাংলাদেশে যেসব ঈদ করেছি, সেগুলোর সবগুলোরই স্মৃতি কমবেশি জামাকাপড় কেনা, খাওয়া-দাওয়া, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানো ইত্যাদিতে ভরা। যদিও আনন্দ থাকলেও সেসব ঈদে বৈচিত্র্য কম। সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল যে ঈদগুলো আমার বিদেশে কেটেছে। একটা ঈদের কথা বলতে চাই—যেরকম অভিজ্ঞতা হয়তো অনেক মানুষের হয় না। আমরা ১৯৫৭ সালে শিলংয়ে গিয়েছিলাম। শিলং আমার মায়ের জন্য একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। কারণ শিলং হচ্ছে আমার নানার বাড়ির মূল অর্থনৈতিক কেন্দ্র। আমার নানির বাড়িরও। তারা ওখানে ব্যবসাবাণিজ্য করত। পশ্চিমবঙ্গের অনেক মানুষ বিশেষ করে বেশ কিছু বাঙালি মুসলমান ওখানে ব্যবসাপাতি করত।
সেবার ওখানে একটা ঈদ কাটিয়েছিলাম আমরা। আমি তখন স্কুলে পড়ি। এখানে একটা কথা বলে রাখি—আমি প্রথম মসজিদে গিয়েছি তিন বছর বয়সের পর, বাবা এবং ভাইদের সঙ্গে। সেটা ছিল ১৯৫৫ সাল। তবে শিলংয়ের ঈদে আমি মসজিদে গিয়েছিলাম কি না আমার ঠিক মনে নেই।
আমার মায়ের জন্য সেটা খুব খুশির একটা ঈদ ছিল। মায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালে। সুতরাং ’৫৭ সালে তার আর কত বয়স! সেটাই বোধহয় ছিল বিয়ের পর শিলংয়ে তার প্রথম ঈদ, যেখানে তার জীবনের অনেক সুন্দর স্মৃতি রয়েছে।
মনে আছে সেই ঈদের দিন সেমাই রান্না করেছিল আমার মা। সেবারই আমি জীবনে প্রথম গোলাপজল আবিষ্কার করেছিলাম। একসময় অনেক প্রচলন ছিল। এখন বাংলাদেশের মানুষেরা এটা ব্যবহার করে কি না আমি জানি না।
সেই ঈদে আমি সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছিলাম মনে আছে। তখনকার দিনের মানুষ বেশিরভাগ তাই পরত। আমার বাবা এবং বড় ভাইরা নামাজ পড়তে গিয়েছিল। শিলংয়ের মসজিদ কেমন, সেখানকার মানুষের ঈদের নামাজের কথা আমার স্মৃতিতে নেই।
আমার নানার আত্মীয়স্বজনরাও ওখানেই থাকতেন এবং তারা বেশ সমৃদ্ধশালী মানুষ ছিলেন। ঈদের দিন দুপুরবেলা আমরা সবাই মিলে যে খাবারটা খেলাম, সেটা আমার মা রান্না করেছিল। কমবেশি ঢাকার রান্নার মতোই ছিল সেটা। শিলংয়ে তো আর আলাদা রকম কোনো কিছু পাওয়া যায় না! তো, খাবার খেয়ে আমার শিলংয়ের কী দেখতে যাব? মনে আছে শিলং খুব ছোট্ট সুন্দর একটা শহর। তবে শিলংয়ে দেখতে যাওয়ার তেমন কিছু ছিল না, নানাদের ওই আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া। দুপুরের খাবার খেয়ে তাই গাড়ি করে আমরা সেই আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দুপুরবেলা শিলং শহর খুব নীরব, তেমন কোনো গাড়িঘোড়া নেই। বেশ জোরেশোরে চালিয়ে নিয়ে গেল ড্রাইভার। দূরে পাহাড়ের ওপর দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট চৌকো টফির মতো বাড়িগুলো। সেখান থেকে অনেকেই বেড়াতে বের হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এরা কারা? আসলে ওরা স্থানীয় মানুষ নয়, বাইরে থেকে এসে এখানে বাড়ি করেছে—অনেকেই কলকাতার বনেদি মুসলমান। তাদের শিলংয়ে একটা করে বাড়ি আছে। তারাই ঈদ করছে, রাস্তাঘাটে নতুন জামাকাপড় পরে বেড়িয়েছে। কারণ শিলং তো এমন কোনো মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল নয়। যাই হোক, পথঘাট আর পাহাড় দেখতে দেখতে আমরা নানাভাইয়ের বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে খুব উৎসব আয়োজন চলছে। অনেক লোকজন। মাকে এত খুশি আমি খুব কম দেখেছি। অনেক দিন পর নিজের মানুষদের সঙ্গে, তার কাজিনদের সঙ্গে সে ঈদ করছে। আমি তো সবার ছোট, সবাই খুব আদর করছে। এরকম করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। তবে ঢাকায় যেরকম গোটা শহরে একটা উৎসব আয়োজন হয়, সেরকমটা ছিল না সেখানে। কিন্তু শিলং শহরে যেই জিনিসটা ছিল—তা হলো এই পুরো ঈদটা সেখানে যে একটা পরিবেশের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, সেটা অত্যন্ত সুন্দর। সারা দুনিয়ার কত দেশে কত শহরে আমি থেকেছি—সেরকম অনুভূতি আর পাইনি। তাই হয়তো এই এতদিন পরে এসেও শিলংয়ের অনেক কিছুই আমার মনে আছে। খুব সুন্দর নিরেট একটা ঈদের স্মৃতি। আমাকে অনেকগুলো উপহার দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো যক্ষের ধনের মতো আমি বুকে আগলে রেখেছিলাম, যাতে কেউ নিয়ে নিতে না পারে। খুব টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম, সেগুলো আবার কেউ নিয়ে না নেয়!
ঈদের দিন সকালবেলার একটা ঘটনার কথা মনে আছে। সকালে অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। তারা সবাই দেখলাম রান্নাঘরের মধ্য দিয়ে বসার ঘরে যাচ্ছে। কারণ ওইখানে বিরাট এক ডেকচিতে করে সেমাই রান্না হয়েছে। ওই সেমাইটা সবাইকে দেওয়া হচ্ছে। সবাই বাটিতে করে সেমাইটা নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছে। এটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে না। তবে আরেকটা জিনিস আমার নজরে পড়েছিল। এটা হলো শ্রেণির বিষয়টা। একজন কাজের লোক এসেছিল। তাকে সেমাই দেওয়া হলো আলাদা পিতলের বাটিতে। অন্যদের দেওয়া হয়েছিল কাচের বাটিতে। আমি তো তখন অত কিছু বুঝি না—ওই বাটিটায় সেমাই খেতে চাইছিলাম। আমাকে বলা হলো, না না না—তোমার ওই বাটি না। আমাকেও কাচের বাটিতেই সেমাই দিল। অর্থাৎ তখনো শ্রেণিগত সেই সংস্কৃতিটা ছিল। যদিও ছোট ছিলাম, তবু আমার কিন্তু তখনই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি এইটা মনে আছে। ওইটুকু বয়সেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, পিতলের বাটিটা হচ্ছে নীচু লোকদের জন্য আর কাচের বাটি হচ্ছে ওপরতলা বা বাড়ির লোকদের জন্য।
পেছনে টায়ার লাগানো পুরোনো আমলের সেই গাড়িতে করে শিলং শহর ঘুরে আমরা আবার বাড়িতে ফিরলাম সন্ধ্যার পর। একটা জায়গায় আমরা থেমেছিলাম। সেখানে পাহাড়ের নিচের দিকে সিঁড়ি চলে গেছে। ওখানে খাসিয়ারা থাকে। তাদের পিঠে বহন করার জন্য ছাপা বলে একটা জিনিস আছে। আমার খুব শখ হয়েছিল ওই ছাপাতে করে এ সিঁড়িটা দিয়ে নামব আর উঠব। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি হলো না।
যখন বাড়ি ফিরলাম এতগুলো খেলনা নিয়ে, যা হয় আরকি, সন্ধ্যাবেলা কেমন যেন বাচ্চাদের জন্য ঈদটা কমে যায়। সকালবেলা খাবার, উপহার, এটা-ওটা কত কি পাওয়া যায়। সন্ধ্যাবেলা তো সেগুলোর পরিমাণ কমে আসে। সেই সময়টাকে আমি জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিলাম। পাহাড়ি শহরে থাকলে সামনের বড় পাহাড়ের ওপরের বাতিগুলোকে আকাশের তারার মতো মনে হয়। মনে হয় অন্ধকারে তারা জ্বলছে। আর শিলং শহরের আরেকটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো, প্রায়ই মেঘ এসে ঢুকে পড়ত ঘরের ভেতরে। আজকের দিনটা তেমন না। বেশ পরিষ্কার আকাশ এবং তার মধ্যে অনেক অনেক বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলছে। অন্ধকারে তো পাহাড় আর আকাশ একাকার হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে শুধু বড় বড় তারা জ্বলছে। আমি দাঁড়িয়ে থেকে অনেকক্ষণ ওই দৃশ্যটা দেখলাম। পরে কে যেন এসে বলল, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, যাও ঘরে যাও। কিন্তু আমার শিলংয়ের ঈদের সবচেয়ে বড় স্মৃতিটা হচ্ছে সন্ধ্যাবেলা সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার মুহূর্তটা।