আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংবিধানের বাইরে একচুলও ছাড় দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কয়েকদিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তা সহজেই অনুমেয়। বিএনপি নেতারাও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলছেন, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে হবে। কোনোভাবেই দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন হতে দেবেন না। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র পাঁচ মাস। এখনো নির্বাচন আয়োজনের রূপরেখা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে দেশের জনগণ। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন স্তরের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা বর্তমান সংবিধানের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকেই নির্বাচন আয়োজন করতে চান। সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে না এলেও তারা বিকল্প ভেবে রেখেছেন। নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয়, সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন জোট-উপজোট সক্রিয় করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী অন্য দলগুলোকে নির্বাচনে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুখে মুখে নির্বাচন নিয়ে উল্টো সুর থাকলেও কয়েকটি দল বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে। ১৯৮৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট বাদে সব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। আগামী নির্বাচনে বিএনপি না এলে অনুসরণ করা হবে ’৮৬-এর নির্বাচনকেই। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে একা করে বাকি দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। যদিও আওয়ামী লীগ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চাইবে বিএনপি নির্বাচনে আসুক। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণেই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ওই সময় ক্ষমতাসীন এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছিল দেশের সব বিরোধী দল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতসহ প্রায় সব দল ছিল একমঞ্চে। শেষ মুহূর্তে ওই নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ, জামায়াতসহ সব বিরোধী দল। নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সাতদলীয় জোট। যদিও জাতীয় পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার আত্মজীবনী ‘আমার কর্ম আমার জীবন’-এ দাবি করেছেন, ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসনের হিস্যা চেয়েছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সাতদলীয় জোট সেই ভাগ না পেয়েই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি এককভাবে ১৫৩ আসন পেয়ে ক্ষমতাসীন হয়। আওয়ামী লীগ পায় ৭৬টি আসন। জামায়াতের ঘরে যায় ১০টি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (সিরাজ), মুসলিম লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন বাম ধারার রাজনৈতিক দলও সেই নির্বাচনে অংশ নেয়। বিভিন্ন ছোট-বড় ইসলামী দলও এতে অংশ নিয়েছিল। এরশাদকে ক্ষমতা থেকে না হটানো পর্যন্ত এসব দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাখলেও শেষ পর্যন্ত তারা কথা রাখেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেও সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। বেশিরভাগ দলই বয়কট করে নির্বাচন। এ ছাড়া বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন ১৫৩ জন এমপি। আগামী নির্বাচনে এ ধরনের বিতর্ক এড়াতে চায় আওয়ামী লীগ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ এবারের নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে ঘন ঘন বাংলাদেশ সফরও করছেন ওইসব দেশের অনেক নীতিনির্ধারক। বিষয়টি আমলেও নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। সংবিধানের মধ্যে থেকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ খুঁজছেন তারা। এ ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটলে বিকল্প ভাবনাও রাখা হয়েছে। যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার পথে না হেঁটে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার চিন্তাই বেশি ক্ষমতাসীনদের। আওয়ামী লীগের এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কালবেলার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচন হবে অংশগ্রহণমূলক, তবে সংবিধানের মধ্যে থেকেই। বিদেশিরাও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও সংবিধানের বাইরে তারা কিছু বলেননি। বিএনপি বর্জন করলে সংবিধানের মধ্যে থেকেই বাকি দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে, এটাই শেষ কথা। দেশে অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে। সেসব দল অংশগ্রহণ করবে। জনগণ যেদিকে রায় দেবে, আমরা মেনে নেব। ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও তারা নির্বাচন জমজমাট করার প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছেন। বিশেষ করে বিএনপি জোটের সঙ্গে বা বিএনপি ঘরানার যেসব দল রয়েছে, ভোটের মাঠে অবস্থান রয়েছে—সেসব দলের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে আলোচনা চলছে। ক্ষমতাসীন দলের এক নেতা বলেন, ইসলামী আন্দোলন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিল। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলটির নেতারা ক্ষুব্ধ হন। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল ভাবছে। তারা ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আশা করা যায়, শেষ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন ক্ষমতাসীনদের অধীনেই নির্বাচনে যাবে। এর বাইরে সারা দেশে ভোটব্যাংক রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর। আগামী নির্বাচনে জামায়াতের অংশ নেওয়ার বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থাকলেও শেষ মুহূর্তে তারা ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। জয়লাভ করে ১০টি আসনে। এ ছাড়া বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল তারা। যদিও পরবর্তী সময়ে গত দেড় দশকে সেই সখ্য আর থাকেনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণা, আগামী নির্বাচনেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নিশ্চয়তা পেলে জামায়াত নির্বাচনে অংশ নেবে। এ ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা, বন্ধ থাকা সব দলীয় কার্যালয় খুলে দেওয়া, স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করার নিশ্চয়তা, কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়গুলো সামনে আনছে জামায়াত। সূত্র বলছে, সারা দেশে জামায়াতের ভোটব্যাংক থাকায় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখানোর ক্ষেত্রে উপযোগী হবে। এমন প্রেক্ষাপটে জামায়াতও তাদের দাবিগুলোর শর্তহীন পূরণ চায়। জামায়াতের মধ্যম সারির এক নেতা কালবেলাকে বলেন, আমরা স্বতন্ত্রভাবেই কর্মসূচি পালন করছি। বিএনপির সঙ্গে জোটগত কোনো বিষয় নেই। এক যুগের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে স্বাভাবিক কার্যক্রমের বিকল্প নেই। এখনো চূড়ান্ত কিছু বলার সময় আসেনি। এ ছাড়া দুই দশকের বেশি সময় ধরে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তারা চাইলেই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারবে না। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টির বর্তমান যে অবস্থা, তার থেকেও খারাপ ফলাফলের দিকে ধাবিত হবে। সে ক্ষেত্রে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বরং জাতীয় পার্টির সুবিধা। এর বাইরে আওয়ামী লীগ তাদের পুরোনো মিত্রদের সক্রিয় করার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে বৈঠক। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘোষণা আসবে যৌথ কর্মসূচিরও। যদিও আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা নানা কর্মসূচি দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রাখছে। চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে নেতাকর্মীদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের জোটের বাইরে থাকা ছোট ছোট ইসলামী দলকে নিয়েও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নানা কাজ চলছে। সরকার চাইছে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন দেখানোর ক্ষেত্রে যেন কোনো বিঘ্ন না ঘটে। যদিও বিএনপি সবকটি সভা-সমাবেশ থেকে জোর কণ্ঠে বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে দেবে না। যে কোনো মূল্যে এ নির্বাচন প্রতিহত করবে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল বলছে, বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত সব কূল হারিয়ে তারা নির্বাচনে আসবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির অপেক্ষায় না থেকে আওয়ামী লীগ চাইছে এখনই সবকিছু গুছিয়ে নিতে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতের দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে নির্বাচনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে চাইছে তারা। যদিও গত বুধবার আওয়ামী লীগের এক অনুষ্ঠানে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিক বা না নিক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। নির্বাচনে বাধা দিতে এলে ছাড় দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালবেলাকে বলেন, প্রকৃত রাজনৈতিক দল দেশ ও জনগণের কল্যাণে, গণতন্ত্রের অগ্রগতিতে বিশ্বাস করলে নির্বাচনে আসবে। আমারও চাই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসুক। আমাদের অঙ্গীকার একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন। এর পরও যদি কেউ না আসে, তার দায় আওয়ামী লীগের নয়। আমাদের দায়িত্বও না কাউকে হাতে-পায়ে ধরে নির্বাচনে নিয়ে আসা। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কারা দেশের অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের পক্ষে। তারা যদি জনগণের মতের তোয়াক্কা না করে, বিরাজনীতিকরণ ও ধর্মান্ধ শক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়, তবে জনগণই বিবেচনা করবে। এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, জনগণ সব দলের নেতাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কারা হালুয়া-রুটির জন্য জনগণের সঙ্গে বেইমানি করবে, কারা হালুয়া-রুটি খাওয়ার জন্য জনগণের অধিকারকে বিসর্জন দেবে, তাদের রাজনীতি ওখানেই শেষ। আর বাংলাদেশের মানুষ এবার কাউকে ছাড় দেবে না। মানুষ রাস্তায় নেমেছে। লাখ লাখ জনতা রাস্তায় নেমেছে। আরও নামবে। যারা হালুয়া-রুটির জন্য জনগণের সঙ্গে বেইমানি করবে, ভোটের অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার বিক্রি করে দেবে, তাদের কাউকেই এবার জনগণ ছাড় দেবে না। বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। যারা বেইমানি করবে, তাদের রাজনীতি সেখানেই শেষ। টিকে থাকতে পারবে না জনগণের আন্দোলনের মুখে। আওয়ামী লীগও টিকতে পারবে না, যারা হালুয়া-রুটি খাবে, তারাও পারবে না।
মন্তব্য করুন