আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে আগামী (২০২৪-২৫) অর্থবছরের বাজেটে বেশিরভাগ পণ্যের শুল্ক অব্যাহতি কিংবা ছাড়ের সুবিধা কাটছাঁট করা হচ্ছে। সংসদ সদস্যদের (এমপি) গাড়ি আমদানি থেকে শুরু করে ফ্রিজ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (এসি), এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানিতেও রেয়াতি সুবিধা কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাগেজ রুলসের আওতায় বিদেশ থেকে পণ্য আনার সুবিধায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে শুল্ক সুবিধায় বড় ধরনের কাটছাঁট করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে এমপিদের গাড়ি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হতে পারে।
বাজেটের এ পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক আরোপের উদ্যোগ ইতিবাচক। কেন তাদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে হবে? তারা তো শুল্ক-কর পরিশোধ করে গাড়ি কেনার ক্ষমতা রাখেন।’
সূত্র জানায়, বাজেটে ২৫০-এর বেশি সিসির মোটরসাইকেলের উপকরণ আমদানিতে নতুন করে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্যের কাস্টমস ট্যারিফ ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে।
দীর্ঘদিন ধরে রামপালসহ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য নিয়ে আসা পণ্যের রেয়াতি সুবিধা শূন্য শতাংশ প্রত্যাহার করে ৫ শতাংশ আরোপ করা হচ্ছে। এতে নতুন করে যেসব উদ্যোক্তা বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপন করবেন, তাদের খরচ বাড়তে পারে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলের শূন্য শতাংশ রেয়াতি সুবিধা সংশোধন করে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। হাইটেক পার্কের মূলধনি যন্ত্র এবং নির্মাণসামগ্রীর আমদানি শুল্ক শূন্য শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। আর উন্নয়ন কার্যক্রম সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক শূন্যের পরিবর্তে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। সিসি ক্যামেরা এবং এটিএমের উপকরণের শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। এতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের খরচ আরও বাড়তে পারে।
ওয়াটার পিউরিফাইর আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া সিএনজি বা এলপিজি ফিলিং স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনার উপকরণের আমদানি শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে ব্যাগেজ রুলে। এ ক্ষেত্রে কোনো যাত্রী চাইলেও লাগেজ বা হ্যান্ডব্যাগে ২৪ ক্যারেটের স্বর্ণ আনতে পারবেন না। চলতি অর্থবছরের একজন যাত্রী ব্যাগেজ রুলের আওতায় দুটি নতুন মোবাইল সেট শুল্ক-কর ছাড়া আনতে পারতেন বা খালাস নিতে পারতেন। আগামী অর্থবছরে শুধু একটি মোবাইল সেট নিয়ে আসতে পারবেন এবং শুল্ক-কর পরিশোধ করে খালাস করতে পারবেন।
এ ছাড়া রেফ্রিজারেটর ও এয়ার কন্ডিশনের কাঁচামালের রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনের স্টিল শিটের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এ-সংক্রান্ত যেসব পণ্যের শুল্ক ১০ শতাংশ রয়েছে, তা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। এলইডি লাইটে নতুন করে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে জেনারেটর তৈরির উপকরণ শূন্য শতাংশ থেকে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইলেকট্রিক খাতের সুইচ, সকেট ও হোল্ডারের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। আয়রন তৈরির কাঁচামাল আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া নতুন করে কাজুবাদামের আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব আসতে পারে। এ ছাড়া রেফারেল হাসপাতাল স্থাপনের যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। আগামী বাজেটে ২৮ ধরনের পণ্যের ন্যূনতম শুল্ক প্রত্যাহার করে নতুন করে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ১৯১ পণ্যের আমদানি শুল্ক যৌক্তিক পর্যায়ে আনার জন্য সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হতে পারে। এ ছাড়া ইলেকট্রিক মিটারের আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। একই সঙ্গে প্রিপেইড কিলোওয়াট মিটারের যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে।
সূত্র আরও জানায়, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরির উপকরণে রেয়াতি সুবিধার প্রস্তাব করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ডায়ালাইসিস রোগীদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও ডায়ালাইসিস সার্কিটের শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া কেপিআইভুক্ত রেয়াতি সুবিধায় নতুন কিছু পণ্য যুক্ত করার প্রস্তাব করা হতে পারে।
এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে ডেঙ্গু রোগ। এই ডেঙ্গু টেস্টের কিট আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব করা হতে পারে বাজেটে। এ ছাড়া কার্পেট শিল্পের কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। দেশে ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদন উৎসাহিত করতে মোটর তৈরির কাঁচামালে রেয়াতি সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হতে পারে বাজেটে।