দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্লাটিনাম জয়ন্তী আজ। স্বাধিকার আদায়ের স্বপ্নসারথি, মুক্তির সংগ্রামের ধারক ও বাহক, বাঙালি জাতির প্রায় সব অর্জনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের নাম। নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর পার করেছে দলটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আগামীতেও নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দলের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার যে প্রতিশ্রুতি ও লক্ষ্য নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ, তা অর্জনে অন্তত পাঁচটি প্রধান চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সঙ্গে দল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে আওয়ামী লীগকেই। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, প্রশাসন নির্ভরতা ও সরকারে বিলীন হয়ে যাওয়া দল, যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলে সরকার ও দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে চ্যালেঞ্জগুলো উতরে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিজয়কে এখনো সুসংহত করা যায়নি। সাম্প্রদায়িকতা এখনো বিজয়ের প্রধান অন্তরায়। ৭৫ বছরের আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ এই সাম্প্রদায়িক শক্তি।’
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনে অবস্থিত রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি এবং শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে আটক ছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। আর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যতম প্রাচীন এ সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এদেশের গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা হলেও দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে শুরু করেন নতুন লড়াই। দীর্ঘ ২১ বছর লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জয়ী হয়ে ২৩ জুন দলটি ক্ষমতায় ফিরে আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর শেখ হাসিনা গত ৪৩ বছর ধরে এ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার সুদক্ষ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে স্বৈরতন্ত্রের চৌহদ্দি পেরিয়ে গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল বাংলার জনগণ। কালের বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বাপ্নিক অভিযাত্রী আওয়ামী লীগ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করলেও করোনা মহামারি ও বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব যে অর্থনৈতিক সংকট পার করছে, তা মোকাবিলাই আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূরাজনৈতিক মারপ্যাঁচ সামলে দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের জন্য মোকাবিলা করতে হতে পারে কঠিন সময়। যদিও আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির আলোকে ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পকর্কে বজায় রেখেছেন। যদিও আওয়ামী লীগ কণ্টাকাকীর্ণ পথ মাড়িয়েই ৭৫ বছর উদযাপন করছে; তবে আগামী দিনগুলোর পথচলা মসৃণ করতে এসব ক্ষেত্রে আরও মুনশিয়ানা দেখাতে হবে বাংলাদেশকে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালবেলাকে বলেন, ‘এই দেশ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যে ঐতিহ্য ও অবদান, সেজন্য অন্য ১০টা দলের চেয়ে জনগণের প্রত্যাশাও এই দলের কাছে বেশি। জনগণের প্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ দলটির। প্রতিযোগিতার এই শতাব্দীতে দেশের সীমিত সম্পদের ব্যবহার করে যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে ভূরাজনীতিও অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে, অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হবে।’
আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক দৃঢ়তার ওপর ভর করে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে। সেই ধারাবাহিকতায় এখন টানা চতুর্থবারের মতো সরকার পরিচালনা করছে দলটি। এ সময় অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হলেও সরকারের মধ্যে দল বিলীন হয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ১৫ বছরের অধিক সময় ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের মূল ভিত্তি তৃণমূলে শৃঙ্খলার ঘাটতির দেখা দিয়েছে। অন্তর্কলহ ও বিরোধ এখন সীমাহীন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষায় দলীয় ‘চেইন অব কমান্ড’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাও আওয়ামী লীগের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ।
এ বিষয়ে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল ফারুক খান কালবেলাকে বলেন, ‘অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো নানাভাবে উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। তাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা ঐতিহ্যবাহী এই দলের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। পেছনের রাস্তা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চাওয়াদের গণতন্ত্রের মাধ্যমে জবাব দিয়ে উন্নয়ন বজায় রেখে বিশ্বের ৩০তম অর্থনীতির দেশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি মোকাবিলা করাও প্রধান চ্যালেঞ্জ।’
দলীয় শৃঙ্খলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে কিছু সমস্যা থাকবেই। সব উসকানি ও গুজব মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থানে এসেছে। ভবিষ্যতেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করেই এগিয়ে যাবে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি হলো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ। ব্যাংকসহ বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি রোধ করে সরকারের সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সরকারের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশের নেতৃবৃন্দই এখন আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছেন। টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছে নানারকম হাইব্রিড সুবিধাবাদী এবং নানা অপরাধে অপরাধীরা। এসব আপদ থেকে আওয়ামী লীগ কীভাবে মুক্ত হবে—সেটি এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও দেশবিরোধী জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। আর এজন্য দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে অর্জনে দলকে সুশৃঙ্খল ও সুগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই।’
এদিকে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এরই মধ্যে ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, আজ রোববার সূর্যোদয়ের সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। এ ছাড়া সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধিদল শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দুপুরে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। পরে একই স্থানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন।