কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষ হত্যা করা ভয়াবহ পাপ

মুফতি মাসউদুর রহমান
মানুষ হত্যা করা ভয়াবহ পাপ

মানুষের জীবন মহান আল্লাহর কুদরতি দান ও মহান নেয়ামত। জীবন এমন এক সম্পদ, কোনো কিছুর সঙ্গে যার তুলনা করা যায় না। যখন কেউ অন্যায়ভাবে একজন নিরীহ মানুষের প্রাণ নিয়ে ফেলে, তখন শুধু একজনের জীবন শেষ হয় না, হারায় মানবতার সম্মান, ভেঙে পড়ে সমাজের স্থিতিশীলতা। ইসলাম জীবনের মর্যাদা রক্ষায় কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। মহান আল্লাহ এবং নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, অন্যায়ভাবে কারও জীবন নেওয়া এক ভয়াবহ পাপ, যা শিরকের পর সবচেয়ে বড় অপরাধ। এ কাজ শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না, পুরো সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তাকে ভয়ংকরভাবে বিপন্ন করে। আজকের সময় আমরা যখন নানা দিক থেকে হিংসা, সংঘাত ও হত্যাকাণ্ড দেখতে পাই, তখন আমাদের অবশ্যই ইসলামী এ শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করে শান্তি ও মানবতার জন্য কাজ করতে হবে। কারণ, মানুষের রক্ত রক্ষা করাই ইসলামের মূল শিক্ষা এবং তা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব। ইসলামে মানুষের রক্তের মূল্য দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘একজন মুমিনের রক্ত ও তার সম্মান-সম্পদ অপর মুমিনের ওপর হারাম।’ (মুসলিম: ২৫৬৪)। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেন, ‘তোমাদের রক্ত, সম্পদ এবং সম্মান একে অপরের জন্য এতটাই পবিত্র, যতটা পবিত্র এই দিন, এই মাস এবং এই শহর।’ (মুসলিম: ১৬৭৯)। এমনকি বায়তুল্লাহর চেয়েও অধিক সম্মান একজন মুমিনের জীবনের। হজরত ইবনে উমর (রা.) কাবাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তুমি কত মর্যাদাবান! তবে একজন মুমিনের সম্মান আল্লাহর কাছে তোমার চেয়েও বেশি।’ (তিরমিজি: ২০৩২)।

মানুষকে হত্যা করা এমন ভয়াবহ পাপ, যা হত্যাকারীর ইহকাল ও পরকাল উভয়টাই ধ্বংস করে দিতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন ধ্বংসকারী পাপকাজ থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী কাজ থেকে বেঁচে থেকো। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, সেগুলো কী? তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, জাদু করা, আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা, অন্যায়ভাবে এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, সুদ খাওয়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা এবং সতীসাধ্বী ইমানদার নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৩)। একজন মানুষ হত্যা কতটা ভয়াবহ তা বোঝাতে কোরআনে একজন মানুষকে পুরো একটি জাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করল, সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল।’ (সুরা মায়িদা: ৩২)। মানুষের মৃত্যুর প্রভাব শুধু নিহত ব্যক্তির দেহেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া, মা-বাবার জীবনে এক গভীর শোক, স্ত্রী ও সন্তানের জন্য এক জীবনের বেদনা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের জন্য এক বড় শূন্যতা। হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির জীবন শেষ করেই ক্ষান্ত হতে পারে না। বরং এর মাধ্যমে সে নিজের এক অভিশপ্ত জীবন শুরু করে—যেই জীবনে ইহকালীন কোনো শান্তি নেই আর পরকালীন কোনো মুক্তি নেই।

হত্যার ফল হিসেবে মানুষের অর্জন জাহান্নাম ও আল্লাহর গজব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার প্রতিদান জাহান্নাম, যেখানে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত হবেন, তাকে লানত দেবেন এবং আল্লাহ তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ৯৩)। এক হাদিসে এসেছে, ‘যদি আকাশ ও পৃথিবীর সবাই মিলে একজন মুমিনকে হত্যা করে, তবে আল্লাহ তাদের সবাইকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’ (তিরমিজি: ১৩৯৮)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুমিন দ্বীনের প্রশান্তি ভোগ করে, যতক্ষণ না সে কোনো রক্তপাত ঘটায়।’ (বুখারি: ৬৮৬২)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে অবৈধভাবে রক্তপাত করে, সে এমন এক বিপদের মুখে পড়ে, যার থেকে মুক্তির পথ নেই।’ (বুখারি: ৬৮৬৩)। হত্যাকারীর আমল নিষ্ফল হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই ব্যক্তি হচ্ছে দেউলিয়া, যে কেয়ামত দিবসে নামাজ, রোজা, জাকাতসহ বহু আমল নিয়ে উপস্থিত হবে এবং এর সঙ্গে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে বা কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে মারধর করেছে ইত্যাদি অপরাধও নিয়ে আসবে। সে তখন বসবে এবং তার নেক আমল হতে এ ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে, ও ব্যক্তি কিছু নিয়ে যাবে। এভাবে সম্পূর্ণ মানুষরা তার সব আমল নিয়ে যাবে এবং তার নেক আমল শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তার পাওনাদার রয়ে যাবে। অতঃপর পাওনাদারদের গোনাহগুলো তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। আর পাহাড়সম গোনাহ নিয়ে সে লাঞ্ছিত অবস্থায় সে জাহান্নামে নিক্ষেপ হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন প্রথম যে বিষয়টির বিচার হবে, তা হলো রক্তপাত।’ (বুখারি: ৬৫৩৩)। এমনকি নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর মাথার চুল ধরে টেনে নিয়ে আসবে আল্লাহর দরবারে। কণ্ঠনালিতে তখনো রক্ত ঝরবে। সে বলবে, ‘হে আল্লাহ! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে।’ (তিরমিজি: ৩০২৯)।

পৃথিবীর প্রথম পাপ মানব হত্যা। হজরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমনের পর তার প্রথম সন্তানের হাতে সংঘটিত হয় প্রথম হত্যাকাণ্ড। হজরত আদম এবং হাওয়া (আ.)-এর অনেক সন্তান ছিল। তাদের দুই ছেলে ছিল কাবিল ও হাবিল। কাবিল ছিল বড়। মা-বাবার কথা মেনে চলত না। হাবিল ছিল ছোট। মা-বাবাকে মেনে চলত। আদম ও হাওয়া (আ.)-এর আকলিমা নামে একটি মেয়ে ছিল। কাবিল তাকে বিয়ে করতে চাইত। কিন্তু আদম ও হাওয়া (আ.) চাইলেন আকলিমাকে ছোট ছেলে হাবিলের সঙ্গে বিয়ে দিতে। কাবিল তা মেনে নিতে পারেনি। এভাবে কাবিল নিজের মা-বাবা এবং ভাইয়ের শত্রু হয়ে গেল। তাদের মধ্যে বেঁধে গেল বিবাদ। তখন সৃষ্ট এ বিবাদ নিরসনে আল্লাহ হুকুম দিলেন, ‘তোমরা কোরবানি করে পাহাড়ের ওপর রেখে এসো। যার কোরবানি কবুল হবে, তার সঙ্গে আকলিমার বিয়ে হবে।’ এটি দেখে বড় ভাই কাবিল খুব রেগে গেল। সে হাবিলকে বলল, ‘আমি তোমাকে হত্যা করব।’ হাবিল বলল, ‘আল্লাহ সৎ বান্দার কোরবানি কবুল করেন। এখন তুমি যদি আমার সঙ্গে লড়াই করো, তবে আমি তোমার গায়ে হাত তুলব না।’ অবশেষে এর জেরে একদিন বড় ভাই কাবিল ছোট ভাই হাবিলকে হত্যা করল। এটা ছিল পৃথিবীর প্রথম মানুষ হত্যা। হাবিলকে হত্যার পর কাবিল চিন্তায় পড়ে গেল যে তার লাশ এখন কী করবে, কীভাবে তা লুকিয়ে রাখবে! তখন কাবিল দেখতে পেল, একটি কাক ঠোঁট দিয়ে মাটি খুঁড়ে অন্য একটি কাককে দাফন করছে। এটা দেখে কাবিলও তার ভাই হাবিলের লাশ মাটির নিচে দাফন করল। এ ঘটনা জানতে পেরে হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) খুব কষ্ট পেলেন।

প্রথম মানব হত্যার এ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কোরআনে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদমের দুই পুত্র (হাবিল ও কাবিল)-এর বৃত্তান্ত তুমি তাদের ভালো করে শোনাও। যখন তারা দুজনে কোরবানি করেছিল তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো আর অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। তাদের একজন বলল, ‘আমি তোমাকে খুন করবই।’ অপরজন বলল, ‘আল্লাহ সংযমীদের কোরবানি কবুল করেন। আমাকে খুন করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে খুন করার জন্য আমি হাত তুলব না; আমি তো বিশ্বজগতের প্রতিপালককে ভয় করি। আমি চাই, তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বইবে ও বাস করবে আগুনে। আর এটাই জালিমদের কর্মফল।’ তারপর তার মন তাকে ভাইকে খুন করতে উত্তেজিত করল ও সে (কাবিল) তাকে (হাবিলকে) হত্যা করল, তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। তারপর আল্লাহ পাঠালেন এক কাক যে তার ভাইয়ের লাশ কীভাবে গোপন করা যায়, তা দেখানোর উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে লাগল। সে বলল, ‘হায়। আমি কি এ-কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি?’ তারপর সে অনুতপ্ত হলো। (সুরা মায়িদা, আয়াত: ২৭-৩১)।

মানুষের জীবন রক্ষার বিষয়টিকে ইসলাম সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। যে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে জীবনকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এমনকি নামাজ, রোজা বা হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতেও যদি প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে, তাহলে ইসলাম এগুলোতেও যথোপযুক্ত ছাড় দেয়। অসুস্থ, দুর্বল বা ভ্রমণরত মানুষের জন্য রোজা ভেঙে ফেলার অনুমতি, মুসাফিরের জন্য ফরজ নামাজকে চার রাকাত থেকে দুই রাকাতে নিয়ে আসা প্রভৃতি বিধানগুলো জীবনের নিরাপত্তার প্রতি ইসলামের সবিশেষ গুরুত্বারোপের নিদর্শন বহন করে। ইসলাম পরিবার ও সমাজকে এমন সুন্দর সুশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে বলে যেখানে প্রতিটি মানুষ নিরাপত্তা, জানমালের সার্বিক সুরক্ষা ও সম্মান নিয়ে জীবন কাটাতে পারে। সন্তানের সঠিক লালনপালন, প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা, দুর্বল ও নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো; এসবই ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অংশ। এগুলোর পাশাপাশি ইসলাম অন্যের ক্ষতি না করারও শিক্ষা দেয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ থাকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৮৪)। সবকিছু বাদ দিলেও শুধু এই একটি হাদিস ইসলামের নিরাপত্তা দর্শনকে একবাক্যে সংজ্ঞায়িত করতে সক্ষম। যদি সমাজে ইসলামের যাবতীয় সুরক্ষামূলক নির্দেশনা, নীতিমালা ও আইন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রতিটি মানুষের জীবন হবে নিরাপদ, সম্মানিত ও শান্তিময়।

লেখক: ইমাম ও খতিব

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাবিতে নয়, যেখানে নেওয়া হচ্ছে হাদির মরদেহ

খালেদা জিয়ার সবশেষ অবস্থা জানালেন ডা. জাহিদ

হাদি হত্যার প্রতিবাদে জুলাই ঐক্যের ‘কফিন মিছিল’

ঢাবি ভর্তিসহ ৫টি পরীক্ষা স্থগিত, পেছাল সমাবর্তন

ছাত্রলীগ নেতাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা

ওসমান হাদির মরদেহ দেশে পৌঁছেছে

দেড় যুগ পর পুলিশ ক্যাডার হলেন আলোচিত দম্পতি

হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের এলএলবি পরীক্ষা স্থগিত

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ

১০

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের শনিবারের নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত 

১১

নরসিংদীতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ

১২

সুদানে ফের হামলা, নিহত ১৬

১৩

নেকটার চার ক্যাটাগরির নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত

১৪

আইনজীবী আলিফ হত্যার আসামি সুকান্ত গ্রেপ্তার

১৫

বাংলাদেশকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন হাদি : মান্না

১৬

ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন প্রতিহত করা যাবে না : আমান

১৭

কোনো উসকানিতে পা না দেওয়ার আহ্বান জামায়াত আমিরের

১৮

গ্রাহকদের ‘দুঃসংবাদ’ দিল তিতাস গ্যাস

১৯

ঢাবির কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হবে হাদিকে

২০
X