বাংলাদেশ পুলিশ অন্যান্য দেশের পুলিশের মতো নয়। এদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে যে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, অধিকাংশ সময়ই তারা সংশ্লিষ্ট দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। গত ৫৪ বছরে পুলিশ বাহিনী বরাবরই নেতিবাচক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের সময় পুলিশ বাহিনীকে সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করার যে নজির তৈরি করা হয়েছে, তা অতীতের যে কোনো সময়ের কলঙ্কজনক অধ্যায়কে ছাপিয়ে গেছে। একসময় স্বৈরাচারী বলতে এরশাদকে বোঝানো হতো; কিন্তু ২০০৯-২০২৪ সালের স্বৈরাচারী সরকারকে দেখে মানুষ এখন এরশাদের প্রশংসা করছে। ২০২৪ সালের দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ কিংবা গণবিপ্লব বা ছাত্র-জনতার বিপ্লবের সময় দেখা গেছে যে, পুলিশ বাহিনী দলীয় মাস্তানদের চেয়েও সহস্র ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভিনদেশি আক্রমণকারী শত্রুরূপে আবির্ভূত হয়েছে। নিজেদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শিকারি পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে লাশ গুম করা হয়েছে। বুটের আঘাতে থেঁতলে ফেলা হয়েছে নাক-মুখ। ভেঙে ফেলা হয়েছে বুকের হাড়। ইন্টারনেট বন্ধ করার কারণে তাৎক্ষণিক অনেক বিষয়ে আমরা জানতে পারিনি, কিন্তু ইদানীং প্রকাশিত অনেক ভিডিও ফুটেজে পুলিশ কর্তৃক নিরস্র মানুষকে হত্যা করার বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে।
বলা হয়ে থাকে, কাক কাকের মাংস খায় না। কিন্তু তথাকথিত মানুষরূপী পুলিশরা মানুষের মাংস ঠিকই খেয়েছে। পুলিশদের সঙ্গে তো শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের ভাড়া করা গুন্ডা বাহিনীর মতোই তারা বিরোধী শক্তির সঙ্গে গত ১৫ বছর হিংস্রতার আচরণ করেছে।
পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপের মাধ্যমেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারে। সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে আন্দোলনকারীদের ভয় দেখাতে পারে। লাঠিপেটা করতে পারে। জলকামান নিক্ষেপ করতে পারে। একেবারেই সর্বশেষ জীবনের ঝুঁকি থাকলে হাঁটুর নিচে গুলি করার অনুমতি আছে। কিন্তু জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে পুলিশ কর্তৃক মানুষ হত্যা করার যে ইচ্ছাকৃত উদ্যোগে ও আগ্রহ লক্ষ করা গেছে, তা কোনোভাবেই সভ্যতা, আধুনিকতা, মানবিকতা ও মনুষত্ববোধের কোনো পর্যায়েই পড়ে না। এর ফলে সাধারণ মানুষ পুলিশের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছে। যার প্রতিফলন আমরা থানাগুলো আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাধ্যমে দেখতে পেয়েছি। নিজস্ব মানুষের ওপর পুলিশের নির্যাতনের এ ঘটনা বলে পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত থাকবে।
পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে তাদের অর্থ বাণিজ্য ও দুর্নীতির কারণে। পুলিশ বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য বেনজীর, আসাদুজ্জামান মিয়া ও ডিবির কুখ্যাত হারুনের অবৈধ সম্পত্তির কিছু নমুনা আমরা ইদানীং দেখতে পেয়েছি। এরকম কত শত হারুনের অস্তিত্ব পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে, তা আমাদের অজানা। বিপ্লবী সরকার গঠিত হওয়ার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি, বেশ কয়েকদিন ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে সড়কের ব্যবস্থাপনা একেবারে ভেঙে পড়ে। এ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করে। এ সময়ে তারা একটি মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একজনকে ধরে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পরিমাণে নগদ অর্থসহ নানাবিধ জিনিস জব্দ করে। স্বাভাবিক অবস্থায় পুলিশের হাতে এ ধরনের আটকের খবর আমরা খুব বেশি পেতাম না।
পুলিশরা বর্তমানে কাজে যোগদান করেছে। কিন্তু রাস্তাঘাটে ট্রাফিক পুলিশসহ থানায় কর্মরত পুলিশদের মধ্যে এক ধরনের দায়িত্ব পালনে অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে ট্রাফিক পুলিশরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। অনেক পুলিশ কাজে যোগদান করেনি। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার কিছুটা দুর্গতি অনুভব করা যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, পুলিশের দুর্নীতি ও দলীয়ভাবে পুলিশ নিয়োগ। এ ছাড়া আন্দোলন চলার সময় পুলিশের ওপর অদৃশ্য শক্তির আক্রমণ তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে। এমন অবস্থায় প্রয়োজন পুলিশ বিভাগের সংস্কার। নিয়োগ দিতে হবে সৎ পুলিশ সদস্য। যেসব সৎ পুলিশ সদস্য গত ১৫ বছরের চাকরিচ্যুত হয়েছে, তাদের কাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের পুলিশের চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সাধারণ মানুষের মন্তব্য হচ্ছে, পুলিশ যেহেতু এখন ঘুষ খেতে পারে না, তাই তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। এমতাবস্থায় পুলিশ বিভাগের উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
নতুন পুলিশ নিয়োগ: বর্তমানে (২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে) পুলিশে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ৭২৪ জন সদস্য রয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিপরীতে পুলিশ সদস্যের অনুপাত ১:৮০০। যারা প্রমাণিত অপরাধী এবং কাজে যোগদান করেনি তাদের আইনানুগ ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকরিচ্যুত করে নতুনদের তদস্থলে নিয়োগ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারির সময় যেভাবে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনি দ্রুত সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ দেওয়া জরুরি। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার ব্যাপক অবনতি হওয়ার আগেই পুলিশ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য যত আগে সম্ভব, এ নিয়োগের উদ্যোগ নিতে হবে।
সমন্বয় কমিটি গঠন: পুলিশ যেহেতু জনগণের সেবক। উন্নত বিশ্বের দৃষ্টান্ত এক্ষেত্রে অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে আমার মতে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানার সাথে ওই এলাকার যতগুলো মসজিদ আছে, সেই মসজিদগুলোর ইমাম বা খতিবদের পর্যায়ক্রমে থেকে একজন, সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণযোগ্য একজন শিক্ষক, ওই এলাকায় বাসকারী উচ্চশিক্ষিত একজন সিনিয়র সিটিজেন, পুলিশ বা আর্মির অবসরপ্রাপ্ত ওই এলাকার যদি পাওয়া যায় একজন সৎ সদস্য, শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে স্কুলে ভোটের মাধ্যমে একজন সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে একজন সদস্য, ওই এলাকার একজন ডাক্তার, ওই এলাকার মাদ্রাসার একজন শিক্ষকসহ আরও যাদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এরকম বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পার, যারা ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট থানা ও ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করবেন।
সফটওয়্যার ব্যবহার: এসব কমিটি অবশ্যই ছয় মাস কিংবা এক বছর পরপর পরিবর্তন করতে হবে, যাতে করে কেউই জগদ্দল পাথর হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে। এরা পুলিশকে সহযোগিতা করবেন, স্বেচ্ছা শ্রম দেবেন, কোনোভাবেই অর্থের সংশ্লিষ্টতা এখানে থাকবে না। একটি কেন্দ্রীয় সফটওয়্যারের মাধ্যমে এসব কমিটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কমিটির সদস্যর কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে এবং তা প্রমাণিত হলে, তিনি পদত্যাগ করবেন বা তার সদস্যপদ বিলুপ্ত হবে। কেন্দ্রীয় পুলিশ দপ্তরে স্থানীয় ভুক্তভোগী ব্যক্তিগণ যেন অভিযোগ দিতে পারেন, সফটওয়্যারের মাধ্যমে তার বন্দোবস্ত করা এবং একটি উপযুক্ত কমিটির মাধ্যমে সেগুলো সুরাহা করে ভুক্তভোগী ব্যক্তিকে অবহিত করার ব্যবস্থা করা।
জনবান্ধব করার উপায়
বিপ্লব-উত্তর শিক্ষার্থীরা ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনকালে সর্বসাধারণ জনতা যেভাবে শিক্ষার্থীদের খাদ্য, পানীয়, নাশতা ও বিভিন্ন রকম খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন, ভবিষ্যতেও রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক পুলিশদের স্থানীয় কমিটি ও সাধারণ মানুষ অনুরূপ আতিথেয়তা দেবেন। তাহলে তারা ঘুষ বা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে না। তারা মানুষের ভালোবাসা পাবে। ফলে পুলিশ জনগণের বন্ধু এই বাক্যের বাস্তবায়ন ঘটবে ইনশাআল্লাহ। তবে এক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশদের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। থানায় অভিযোগ নিয়ে গমনকারী যে কোনো ব্যক্তির অভিযোগকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাদের সমস্যার সমাধান করলে মানুষ পুলিশের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রদর্শন করবে। নিয়মিত পুলিশদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
নৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা: পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত সদস্যদের নিয়মিত নৈতিক প্রশিক্ষণ তথা ধর্মীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক পাঠগুলো যেন তারা জানতে পারে, সে ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নিতে হবে। এর মাধ্যমে তারা জানতে পারবে যে, জনগণের সেবা করার মাধ্যমে চাকরির পাশাপাশি পরকালীন মুক্তিরও সুযোগ রয়েছে। তাহলে পুলিশ বাহিনীকে নিয়মিত নৈতিক, ধর্মীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত সেবক বাহিনীতে পরিণত করা সম্ভব হবে, ইনশাআল্লাহ।
পোশাক পরিবর্তন: পুলিশের পোশাক পরিবর্তন। এটি সাধারণ মানুষসহ বিশেষজ্ঞদের একটি দাবিতে পরিণত হয়েছে। নতুন করে পুলিশ বাহিনীকে সাজাতে পোশাকের মাধ্যমে নতুনত্ব আনা একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু শুধু বাহ্যিকতা নয়, ভেতরের থেকেও পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি। দীর্ঘদিনের পুলিশ পরিষেবার যে অবনতি হয়েছে, রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে কিংবা সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজদের ঢাল হয়ে পুলিশ যেভাবে একটি স্বৈরতান্ত্রিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, এটিকে পরিবর্তন করতে কাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সময়ের একান্ত দাবি।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়