অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৫৭ এএম
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিল্প সংস্কৃতির অচলায়তন ভাঙতে হবে

শিল্প সংস্কৃতির অচলায়তন ভাঙতে হবে

মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ণতা দিয়েছিল সংস্কৃতি। পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতি ও বাঙালিয়ানা ধ্বংসের যে পাঁয়তারা, তার জবাব দিয়েছিল বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে সারা দেশে স্লোগান আর দেয়াললিখন ছিল এক-একটি বাংলা অক্ষর একজন বাঙালির প্রাণ। শব্দ, অক্ষর বা ভাষা যে জাতির প্রাণ হতে পারে, তা আমাদের কি আগে জানা ছিল?

সংস্কৃতি তখন আমাদের কী কী দিয়েছে তার হিসাব করলে চমৎকৃত হওয়ার বিকল্প থাকে না। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রবীন্দ্রনাথকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বলা উচিত সংস্কৃতিই তাকে ফিরিয়ে এনেছিল। নজরুলের মতো কবিকেও নতুনভাবে পেয়েছিলাম বলেই তিনি আজ আমাদের জাতীয় কবি। শুধু কবি বা কবিতা নয়, গান-নাটক-সিনেমা বা চিত্রকলা প্রায় সব বিষয়ে সংস্কৃতি আমাদের নতুন এক জীবন দান করে, যার নাম বাঙালি জীবন। দুনিয়ার নানা দেশে ঘোরা ও পরিভ্রমণের সুযোগে আমি এটা জানি, সংস্কৃতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি; যার মূল বিষয় কথা বলা বা বলতে পারা। মানুষ তো আসলে কথাই বলে সবকিছুতে। কবিতা-গল্প বা প্রবন্ধেই শুধু বলে? না। চিত্রকলার ভেতর দিয়েও সে তার না বলা কথাই বের করে আনে, যা করে নাটক-যাত্রা বা অন্য কোনো মাধ্যমেও। এই কথা বলার জায়গাটা ঠিক না থাকলে বা মুক্ত না হলে বিপদ। একটা গল্প মনে পড়ছে—আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে রাশিয়ার সেই বিখ্যাত গল্পটি। ক্রুশ্চেভ তখন প্রধানমন্ত্রী; পলিটব্যুরোর এক সভায় তিনি দুঃখ করে বলছিলেন, অনেক কথা আমরা স্ট্যালিনের আমলে বলতে পারতাম না। এমন সময় নীরব সভাস্থলের মাঝখান থেকে কে যেন বলে উঠলেন—কেন, বলতে পারতেন না কেন? তখন তো আপনি পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন।

ভাষণ থামিয়ে ক্রুশ্চেভ জানতে চাইলেন, কে বললেন এই কথা? কেউ কিছু বলে না। থমথমে নীরবতা। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, আমি কথা দিচ্ছি আপনি দাঁড়ান, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। বরং আপনাকে দেখে অনেকেই সাহস পাবে। তবু কেউ দাঁড়ালেন না। কয়েকবার বলার পর তিনি হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক একই কারণে আমরাও তখন বলতে সাহস পেতাম না।

স্বাধীনতার জন্য দুটি বিষয় অনিবার্য। একটি ভোট, আরেকটি কথা বলার অধিকার। কথা বলা মানে কিন্তু তোতার মতো শেখানো বুলি আওড়ানো নয়। গঠনমূলক আর সত্য বলার অধিকারের নামই মুক্তি। সে জায়গা থেকে আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের ৫৩ বছরে কোনো সরকারই সত্য বলতে দিত না। কেউ আংশিক, কেউ খণ্ডিত, কেউ তাদের মনের মতো করে বলার অধিকার দিলেও মূল কথা বলতে পারা ছিল কঠিন। ফলে একাধিক সরকারকে বিদায় করতে বাধ্য করেছে জনগণ। তারপরও কারও কোনো শিক্ষা হয়নি। কেউ তা থেকে পাঠ নেয়নি। নিলে দেশ ছেড়ে ভেগে যাওয়ার মতো বাস্তবতা দেখতে হতো না।

সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে সংস্কৃতির। কীভাবে তা সংঘটিত হয়েছে, তা কমবেশি জানা আছে সবার। শুরুতে আমরা যেটাকে প্রশংসা ভাবতাম, দেখা গেল তা রুটিন হয়ে দাঁড়াল। এক কথা, এক বক্তব্য আর এক ধরনের স্তাবকতা। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি জড়িত ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতির মানুষজন। আমি সিনিয়র একজন প্রবীণ লেখককে প্রশ্ন করেছিলাম, সর্বাধিক বিক্রিত যে আত্মজীবনী—তা এতকাল কোথায় গচ্ছিত ছিল? কেন তার আভাসটুকুও পেল না কেউ? আমার এই নিতান্ত সাধারণ জিজ্ঞাসার কুটিল উত্তর আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। এই যে ভয় লাগানো বা ভয় জাগানো, এটা যেমন ছিল একটা দিক, আরেক দিকে ছিল স্তুতিবাদ। এই চক্রে পড়ে কত ভগবান যে ভূত হয়ে গিয়েছিলেন, আজ তার হিসাব করলে আমরা চমকে যাব। যাদের আমরা দিকপাল জানি বা মানি তাদের কেউই আর কথা বলতেন না। যদি বলতেনও তা সবার জানা। নিন্দা সমালোচনা আর হক কথা বলা যে অধিকার, সেটা প্রায় লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল; যার চরম মূল্য চোকাচ্ছে সংস্কৃতি।

আজকাল কেউ আর গানবাজনা করে না। করলেও তা বলার সাহস রাখে না। অথচ বাংলাদেশ সুরের দেশ। এ দেশের নদীর কল্লোলে সুর, মেহনতি মানুষের কাজের সুর, বিয়ে-উৎসবে সুর—এমনকি বেদনায়ও সুর আর গান। দেশে মহল্লা বা পাড়ায় গানের রেওয়াজ বিলুপ্তপ্রায়। ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম তবলার দিন শেষ। বিগত দুই দশকে কেউ তার খবর রাখেনি। কেন তা বন্ধ হয়েছে, কারা তা বন্ধ করেছে বা কীভাবে তার সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কথা বলেনি কেউ। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে মিডিয়ায় এর প্রভাব।

বাংলাদেশে রেডিও জকি নামে পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বললে আপনি ভয় পাবেন। সকালবেলার এক অনুষ্ঠানে আমাকে ইন্টারভিউ করার জন্য আসা এক বিখ্যাত জকির পোশাক দেখে আমি ভেবেছিলাম, তিনি মূল্যবোধ বা নৈতিকতাবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠানের হোস্ট। শিল্প সংস্কৃতিবিষয়ক আয়োজনে তার মতো বিখ্যাতজন থাকা মানেই চাকা ঘুরছিল। এই চাকা যে পেছন দিকে যাচ্ছিল এটা যারা দেখেছেন বা বুঝতে পেরেছিলেন, তারা মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন। কারণ তাদের ততদিনে জানা হয়ে গিয়েছিল উপার্জনের বাইরে আরাম-আয়েশের বাইরে আর কিছু নেই। সে আরাম-আয়েশ কতটা বা কতদিন টেকসই, তা তারা ভাবেননি। সেটা তাদের অভিরুচি ও কর্মফল। কিন্তু আমরা দেখলাম ধর্মের ভিড়ে একটি শিল্পবান্ধব প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হলো না। নতুন করে শিল্পকলা বা তেমন কোনো একাডেমি হলো না কোথাও।

রাজধানীর যে মহান বাংলা একাডেমি, তার কাজ হয়ে গেল বছরে একবার পুরস্কার দেওয়া। সে পদক কে পাবেন বা পেতে পারেন, তার জন্য কী কী করতে হতো সে এখন এক ইতিহাস। লাভ কী হলো? লাভ এই, বাংলা একাডেমি পদকভূষিতরা ছবি তুললেন, সামাজিক মিডিয়া ফাটিয়ে দিলেন—এটুকুই। নয়া কবিতা গান নাটক বা নিবন্ধের ঘরে অশ্বডিম্ব। তাহলে সাহিত্য কীভাবে এগোবে?

যারা রাষ্ট্র চালাতেন, তারা ভুলে গিয়েছিলেন একদা জনগণ ও শিল্পই তাদের সাহস আর প্রেরণা জোগাত। কঠিন সময়ের পথনাটক গান বা প্রতিবাদী কবিতা ছড়া তাদের আর ভালো লাগত না। ফলে যুক্ত হতে লাগল সভাকবির দল। একসময় আস্তে আস্তে ভাটা পড়ে গেল সবকিছুতে। অথচ আমরা বিশ্ব ইতিহাসে দেখি ফরাসি রুশ বা যে কোনো বিপ্লবে সাহিত্য শিল্পই ছিল পুরোভাগে। একা ভিক্টর হুগো কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন জগৎ। আমাদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কম কীসে?

হলো না। আর হলো না এসব। প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেল। আমরা দেখলাম আর চুপ থাকলাম। আমরা ভুলে গেলাম এভাবে চললে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি মারা যাবে। বাঁচলেও জীবান্মৃত হয়ে বাঁচবে, যার ফোঁস আছে কিন্তু বিষ নেই। এমন সংস্কৃতি কি আমরা চেয়েছিলাম? যে আদর্শ মূল্যবোধ আর ভাবনা বাঙালিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপিতা ও মহান ভাষা আন্দোলন দিয়েছিল; তার সর্বনাশ করতে পিছপা হননি কেউ। আজ সারা দেশে যে সংকট, তা থেকে উত্তরণের জন্য আপনি আর যাই করেন, শিল্প সংস্কৃতির কাছে কি যেতে পারেন? কারণ তার দুয়ারে তালা।

সে তালা খোলার সময় এসেছে। যতই বৈরী হোক, সময়ই উত্তর দেবে। আমার ধারণা, আমার বিশ্বাস, প্রকৃতি দেশ আর মাটি মিলে যে সংস্কৃতি তার বিনাশ নাই। তার দুঃসময় থাকতে পারে, কিন্তু হনন হয় না। আমাদের দেশ ও জাতি গানবাজনা, নাটক-কবিতা ছাড়া কীভাবে বাঁচবে? নানা দেশের থেকে শুধু ধার নিয়ে তার চলবে না। তোলা দুধে শিশু বাঁচে না, তোলা ধার করা কিছুতে সংস্কৃতিও বাঁচবে না। শিকড়ে ফিরুন। দেশের মাটির গন্ধমাখা ঐতিহ্য আদর্শে মন দিন। দুয়ার খুলে যাবে। তখন আবার সংস্কৃতি পথ দেখাবে। দয়া করে তোষামোদী আর স্তাবকতা রোধ করুন। শিল্প স্বাধীন, সে কোনো রাজা-বাদশার ধার ধারে না। জনগণই তার মালিক।

লেখক: সিডনিপ্রবাসী ছড়াকার ও প্রবন্ধকার

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ময়মনসিংহে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার

ধানের শীষের বিজয় মানেই জনগণের মুক্তি : গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

বাবর আজমকে নিয়ে ধারাভাষ্যে রমিজ রাজার তির্যক মন্তব্য

‘সঠিক ও মানসম্পন্ন সংবাদ উপস্থাপনে সাংবাদিকদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে’

আন্দরকিল্লা মসজিদ আইকনিক করতে ব্যয় ৩০০ কোটি

মেসির চেয়েও ধনী শুধু দুইজন ক্রীড়াবিদ!

প্রবাসীর ছেলেকে দাদা-দাদির কবরের পাশে ঠাঁই দিল না চাচারা

শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

বিপিএলের জন্য নতুন রূপে প্রস্তুত হচ্ছে রাজশাহী স্টেডিয়াম

১০

সাংবাদিককে আটক করে পুলিশের মারধর, গায়েব করার হুমকি

১১

রেড ক্রিসেন্ট থেকে এনসিপি নেতাকে অব্যাহতি

১২

নাসিরের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে আবারও এনসিএল শিরোপা রংপুরের ঘরে

১৩

কিশোরগঞ্জ থাকবে ঢাকাতেই, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

১৪

মক্কায় ১২৫ কিমি এলাকাজুড়ে স্বর্ণের খনির সন্ধান 

১৫

অগ্রযাত্রায় নবীন শিক্ষকদের অবদান রাখতে হবে : খুবি উপাচার্য

১৬

কক্সবাজার সৈকত থেকে অর্ধশতাধিক টংঘর উচ্ছেদ

১৭

১২ থেকে ১৫ ঘণ্টার মধ্যেই রাকসু নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ : ভিসি

১৮

কুলদীপের ঘূর্ণিতে ফলোঅন, তবু লড়াইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

১৯

শেবাচিমে আধুনিক ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগ চালু

২০
X