রাজনৈতিক সরকার গঠিত হলে আগের মতো দলবাজি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, সরকারদলীয় লোকদের ধন-সম্পদ অর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে যাতে সংস্কার লক্ষ্যচ্যুত না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন মহল, সুশীল সমাজ এবং ক্ষমতাসীন সরকারি ব্যক্তিবর্গকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বোপরি দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, স্বভাব, মন ও মননশীলতা, রুচি, নৈতিকতা ইত্যাদির পরিবর্তন না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।
গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন সরকার বল প্রয়োগে দমন করতে গেলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে বেশ কয়েকশ ছাত্র-জনতা নিহত হন। ফলে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন একদফা সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। নানা কারণে সরকারের প্রতি রুষ্ট দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণে এক গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে প্রাণ রক্ষার্থে ভারতে চলে যান। আন্দোলনকারী ছাত্রদের অনুরোধে দেশ-বিদেশে নন্দিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাকে সহায়তার জন্য দুই দফায় ২০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে গত ৮ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৫৮১ জন ছাত্র-জনতা শহীদ হন এবং প্রায় ৩১ হাজার মানুষ আহত হন বলে ছাত্রদের একটি জরিপে প্রকাশ হয়; যদিও সরকারিভাবে এখনো কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
দেশে ১৫ বছরের অধিক সময় পর্যন্ত একদলীয় শাসনে গণতন্ত্রহীনতা, আইনের শাসনের অবনতি, সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়ন, এমনকি ‘গুম’ করার ঘটনা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার প্রভৃতির মতো জনবিরোধী বিষয়ের অভিযোগ ওঠে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ফ্যাসিবাদী শাসন, ব্যাংক খাতের দুরবস্থা, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, কতিপয় অলিগার্ক ব্যবসায়ীর ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, ভোটের অধিকার হরণ, পুলিশ ও র্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার প্রভৃতি কারণেই আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে গণবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
দীর্ঘ অপশাসনে ক্ষয়ে যাওয়া রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা মেরামতে অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও বর্তমান সরকারের এ উদ্যোগে নীতিগত সমর্থন দিয়েছে এবং সংস্কারের প্রস্তাব প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যুক্তিসংগত সময় দিতে রাজি হয়েছে। অনেকের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারই উপযুক্ত। তবে সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকতে হবে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংশোধনের জন্য ৬টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য এতদসংক্রান্ত আদেশ জারি করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক মাস সময় নিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম প্রভৃতি সংস্কারের জন্য আরও কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট বা প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লবের উদ্দেশ্য তথা জনগণের বৃহত্তর অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দেশের কতিপয় ক্ষেত্রে সংস্কার অবশ্যম্ভাবী—এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তর্বর্তী সরকার সূচিত কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের পরিপূরক হিসেবে আমার কিছু ধারণা ও চিন্তা-ভাবনা জনসমক্ষে পেশ করার জন্য আজকের এ লেখা।
রাজনৈতিক সংস্কার: ১৯৭২ সালের সংবিধানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাক-স্বাধীনতা, সর্বজনীন ভোটাধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা থাকলেও ১৭টি সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করে শাসক শ্রেণি স্বীয় উদ্দেশ্য চরিতার্থে সংবিধানকে ব্যবহার করেছে। দেশে বহুদলীয় রাজনীতির বিধান থাকলেও কতিপয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল প্রতিহিংসা ও পাল্টাপাল্টির রাজনীতিতে লিপ্ত। এ প্রতিহিংসার রাজনীতি আমলাতন্ত্র, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণের দ্বারা কলুষিত করেছে। বিপক্ষ দল দমনে হামলা-মামলা, গুম ইত্যাদি ঘটেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের দেওয়া বিভিন্ন মিথ্যা ও গায়েবি মামলায় বিপক্ষ বা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা জেল-জুলুমসহ অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করেছেন। যে সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল তারাই একই পথে হেঁটেছে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। উল্লেখ্য যে, বিগত সরকারের দেওয়া কথিত ‘গায়েবি’ মামলা দেওয়ার প্রথা এখনো বন্ধ হয়নি। ছাত্র আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, সম্পদ বিনষ্ট ইত্যাদিতে জড়িতদের পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে রাজনৈতিক মদদে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকেও মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার না করা হলে অন্য কোনো সংস্কার টেকসই হবে না। সুশীল সমাজের মতে, রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি মেরামতে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও জনমুখী নিয়মনীতির প্রবর্তন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য খুবই প্রয়োজন।
জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বর্তমানে সর্বজনস্বীকৃত। কোনো সরকার বা রাজনৈতিক দল কিংবা বিচার বিভাগ যাতে এ ব্যবস্থায় হাত দিতে না পারে, সেরূপ বিধি-বিধান বা ব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার: প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে আমলাতন্ত্র, পুলিশ, বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক পদধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি প্রবর্তন ও প্রণয়নের পাশাপাশি যোগ্য লোক নিয়োগের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পূরণ করতে হবে। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা আমাদের নির্বাচন কমিশন সংস্কারে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।
স্বাধীন বিচার বিভাগ সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ও জনগণের কাঙ্ক্ষিত হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনার প্রাধান্য মোটেই কাম্য নয়; বরং মেধা, সততা, নীতি-নৈতিকতার প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী স্রোতের অনুকূলে রায় প্রদান এদেশে নিয়মে পরিণত হয়েছিল। অনেক বিচারক ভুলে যান যে, পক্ষপাতদুষ্ট রায়ের জন্য তাকে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বিচার বিভাগ সংস্কারের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা আশু প্রয়োজন।
জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র সংস্কারের জন্য একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করি এ কমিশন বিধি-বিধান, প্রশাসনিক আদেশ ইত্যাদি সুপারিশ করে আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণ, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব থেকে রক্ষা করবে। ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হবে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা স্থায়ী কাঠামোর অংশ হিসেবে সব সরকারের সঙ্গেই স্বাধীন ও নির্মোহভাবে কাজ করবে। নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদায়ন, পদোন্নতি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রের সদস্যরা যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে বিবেচিত হবেন। আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে সব ক্যাডার কর্মকর্তার জন্য সমান সুযোগসুবিধার বিধান করতে হবে।
অর্থনৈতিক সংস্কার: বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতি নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের আধিক্য, বেনামি ঋণ গ্রহণ করে আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের মাধ্যমে এ খাত খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, রাজস্ব আহরণের অপ্রতুলতা ও ফলস্বরূপ সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝা বৃদ্ধি, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা ইত্যাদি বিষয়গুলো দেশের অর্থনীতিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিগত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রী পর্যায়ে নীতি-নির্ধারণে ব্যর্থতা। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা ছিল অনুপস্থিত। এমতাবস্থায়, ব্যাংক খাতের সংস্কারে শিগগির ব্যাংক কমিশন গঠন করতে হবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংস্থাগুলো কৃষক, উৎপাদক ও স্থানীয় সরকারি দপ্তরগুলোর সহায়তা নিতে পারে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আমদানির ক্ষেত্রে বেশিসংখ্যক আমদানিকারককে সুযোগ দিতে হবে। এলসি রিলিজ করা সহজ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার অস্থিতিশীল না করেন, সেজন্য ব্যবসায়ী সংগঠন ও বৃহৎ উৎপাদকদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সভা করে তাদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের কার্টেল কিংবা অতি মুনাফাখোরির প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে। যে কোনো সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি বড় কারণ।
দেশের অর্থনীতির স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য শিল্পকারখানায় পূর্ণ উদ্যমে উৎপাদন চালিয়ে যেতে হবে। সেজন্য কলকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে সেজন্য উৎপাদকদের অনুকূল নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে।
সাবেক সরকারের পতনের পর বিশ্বব্যাংকসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন খাতে ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাবে। আমদানি সক্ষমতা বাড়বে এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য স্থিতিশীল হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে এসব ঋণের সদ্ব্যবহার হয়। দেশের বৈদেশিক ঋণ বিগত সরকারের সময়ই ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহে জোর দিতে হবে। কর আহরণ বৃদ্ধির জন্য এনবিআরের প্রশাসনিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন, টেকসই অটোমেশন ও করের আওতা সম্প্রসারণ করতে হবে। উপরন্তু অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও থিঙ্কট্যাঙ্কগুলোসহ একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
শিক্ষা সংস্কার: দেশের উন্নয়নে মেধাভিত্তিক সুশিক্ষা অতীব প্রয়োজনীয়। বেশ কিছু বছর ধরে নৈর্ব্যক্তিক, টিক চিহ্ন, সৃজনশীল প্রশ্ন ও নানারকম উদ্ভট সিলেবাস প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার মানের অবনতি ঘটানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতিও শিক্ষার মান হ্রাসের কারণ। প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক, ব্যবহার উপযোগী কারিকুলাম প্রণয়ন করে ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস ও বইমুখী করতে হবে। একটি যুগোপযোগী গণমুখী শিক্ষা কমিশন গঠনের পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা অধিদপ্তর, এনসিটিবি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে দক্ষ জনবল পদায়ন করে এগুলো শক্তিশালী করতে হবে। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যোগ্যতা, দক্ষতা ও ইতিবাচক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য যেসব কমিশন গঠন করা হয়েছে, এসব কমিশনের দৃষ্টিগ্রাহ্য তৎপরতা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কমিশন কর্তৃক যথাসময়ে প্রতিবেদন প্রণয়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া এসব প্রতিবেদন বাস্তবায়নের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী শাসনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ প্রভৃতি সব ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়েছে। দেশের জনগণ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী প্রভৃতি সব শ্রেণির মধ্যেই এক ধরনের অসহিষ্ণুতা, অসততা ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দেখা যাচ্ছে। ফলে দেশে শৃঙ্খলা আনয়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।
টেকসই সংস্কারের মাধ্যমে উপর্যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সরকার পরিবর্তন হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মে কোনো প্রভাব না পড়ে। রাষ্ট্র সংস্কার একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কয়েক বছরে তা সম্ভব নয়। এর জন্য দলমত নির্বিশেষে ঐকমত্যের প্রয়োজন। নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে এখনই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। বেশি দীর্ঘায়িত হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টারা বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। সেজন্য সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বহালের ঐকমত্য হতে হবে। রাজনৈতিক সরকার গঠিত হলে আগের মতো দলবাজি, সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, সরকারদলীয় লোকদের ধন-সম্পদ অর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে যাতে সংস্কার লক্ষ্যচ্যুত না হয়, সে ব্যাপারে সচেতন মহল, সুশীল সমাজ এবং ক্ষমতাসীন সরকারি ব্যক্তিবর্গকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বোপরি দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, স্বভাব, মন ও মননশীলতা, রুচি, নৈতিকতা ইত্যাদির পরিবর্তন না হলে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রদূত