আমাদের অজান্তেই প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কোলাহলের মাঝে এক নীরব পরিবর্তন ঘটে চলছে—এটি কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা বা অর্থনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে নয়। বরং এটি মানুষ কীভাবে সংযোগ স্থাপন করে, যোগাযোগ করে এবং বিশ্বকে দেখে—সেই ধারণাগুলোর মধ্যে এক ধীরলয়ের পরিবর্তন। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, যা দেশে এরই মধ্যে গভীরভাবে মিশে গেছে এবং নতুনভাবে সামাজিক নিয়ম ও আচরণ গড়ে তুলছে। দেশে সামাজিক মাধ্যমের দ্রুত বিকাশ সত্যিই বিস্ময়কর! চার কোটিরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীসহ দেশটি এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। ফলে এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ডিজিটালভাবে সংযুক্ত দেশ হয়ে উঠেছে। শহর থেকে শুরু করে দূরবর্তী এলাকাগুলোতেও ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন এখন সহজলভ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মানুষকে ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে—যেখানে বন্ধুত্ব তৈরি হয়, খবর বিনিময় হয়, নিজস্ব মতামত এবং পরিচয় তৈরি করা হয়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক, লিঙ্কডিইন, টুইটারসহ নানা প্ল্যাটফর্ম আমাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই প্রভাব আর্থসামাজিক উন্নয়ন, ব্যবসা, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও মানসিক স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর ওপর স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়।
ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধি: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অন্যতম বড় প্রভাব পড়েছে ব্যবসা ক্ষেত্রে। দেশে ই-কমার্সের প্রসার ঘটছে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে। বাংলাদেশের অনেক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে সরাসরি পণ্য বিক্রির সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি অনলাইন মাধ্যমে পণ্য ও সেবা প্রদানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। গ্রাম থেকে শহরের মানুষের কাছে নিজেদের পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা পাচ্ছেন অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘বিডি বাজার’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিজস্ব পণ্য অনলাইনে তুলে ধরার সুযোগ করে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের চাহিদা বুঝে নেওয়া সহজ হচ্ছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শুধু বিনোদনের বা ব্যবসায়িক কাজের জন্য নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও এখন একটি বড় ভূমিকা রাখছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষামূলক পেজ ও গ্রুপে যুক্ত হয়ে নানা তথ্য ও শিক্ষা উপকরণ পাচ্ছে। ইউটিউবের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন বিষয় শেখার সুযোগ পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘শিখতে চাই’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি শেখার জন্য ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে সহায়তা দিচ্ছে। পাশাপাশি, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সহজে কোর্সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকায় ছাত্রছাত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারছে।
ক্যারিয়ার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি: বাংলাদেশের তরুণ সমাজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহার করে নিজেদের ক্যারিয়ার তৈরি করছে। ফ্রিল্যান্সিং, ব্লগিং, ভিডিও কনটেন্ট ক্রিয়েশন, গ্রাফিক ডিজাইন এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো কাজগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অনেক তরুণ ইউটিউব ও ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করে আয়ের পথ তৈরি করেছেন। একইভাবে লিঙ্কডিইন প্ল্যাটফর্মে পেশাদাররা নিজেদের প্রোফাইল তৈরি করে চাকরি ও নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ পাচ্ছেন।
তবে সামাজিকমাধ্যমের এ সংযোগের প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি এর অতিরিক্ত ব্যবহার বাংলাদেশের সমাজে উল্লেখযোগ্যভাবে আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলছে। সামাজিক মাধ্যমের চাপে সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাবগুলোর একটি হলো সামাজিক বন্ধন ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের দুর্বলতা। পরিবার ও কমিউনিটির মূল্যবোধ যেই সমাজে সর্বদাই উচ্চভাবে গণ্য হয়েছে, সেখানে ভার্চুয়াল সংযোগের উত্থান সরাসরি, মুখোমুখি সম্পর্ককে ছাপিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের অনেক মানুষ এখন বাস্তবজীবনে বন্ধুদের বা প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানোর চেয়ে অনলাইনে তাদের সঙ্গে সামাজিকীকরণে বেশি সময় ব্যয় করে, যা একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বাড়াচ্ছে।
এ ছাড়া, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর ক্রমাগত কিউরেটেড ছবি ও গল্পের প্রবাহ একটি প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, যেখানে একজনের মূল্যায়ন করা হচ্ছে লাইক ও ফলোয়ার সংখ্যা দ্বারা। এর ফলে অনেক মানুষ, বিশেষ করে যারা সামাজিকমাধ্যমের চাপে বেশি সংবেদনশীল, তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, দুঃখবোধ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাবের অনুভূতি বাড়ছে। সামাজিকমাধ্যমের প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর। প্রচুর পরিমাণে কনটেন্টের ক্রমাগত চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে অনেক মানুষই তাদের ডিভাইস থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছে না, ফলে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও অস্বস্তির সৃষ্টি হচ্ছে। গবেষণায় স্পষ্টভাবে দেখা গেছে, সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাব যেমন—বাড়তি বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং ঘুমের সমস্যার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
এ ছাড়া ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভুয়া তথ্য ও গুজবের বিস্তার খবরের উৎস এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি আস্থাকে দুর্বল করে দিচ্ছে, যার ফলে জনমতের বিভক্তি বাড়ছে। করোনার সময়ে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফেক নিউজ ব্যাপক আকারে ছড়িয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। এমন একটি দেশে যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা এখনো বিদ্যমান, সেখানে সামাজিকমাধ্যমে গুজব ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিস্তার আরও উত্তেজনা ও বিভাজন সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো তাদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ। অনেক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করে হুমকি বা ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা ঘটছে। তবে এ সামাজিকমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাবের মধ্যেও আশা এবং অন্যরকম এক শক্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষই অনলাইনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে এবং তাদের ডিজিটাল অভ্যাস পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিচ্ছে। ডিজিটাল ডিটক্স রিট্রিট এবং দায়িত্বশীল অনলাইন আচরণ প্রচারের জন্য স্থানীয় প্রচারণার মতো উদ্যোগগুলো গড়ে উঠছে, যা প্রযুক্তির সচেতন ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।
এ ছাড়া ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোও তাদের পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কিছু নেতিবাচক দিক নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। এসব প্ল্যাটফর্ম অবশ্যই মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উপায়গুলো বদলে দিয়েছে এবং স্বাধীন মতামতকে শক্তিশালী করেছে, তবে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোও বেড়েছে।
এই অগ্রগতির যুগে, বাংলাদেশকে ডিজিটাল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। স্পষ্টতই, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সামাজিকমাধ্যমের সুবিধা ও অসুবিধার মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঠিক ও নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে বিশেষ কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। এ ছাড়া এসব মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করতে হবে। বিশেষ করে সাইবার বুলিংয়ের শিকারদের জন্য মানসিক পরামর্শ সেবা প্রদান করতে হবে। সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় কঠোর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়াও প্রয়োজন। গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য রোধে ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও কার্যকর করতে হবে। মিডিয়াগুলোর উচিত সঠিক তথ্য যাচাই করা এবং জনগণকে উৎসাহিত করা যাতে তারা গুজব বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকে।
সর্বোপরি, ডিজিটাল সাক্ষরতা, দায়িত্বশীল অনলাইন আচরণ এবং সচেতনতার মূল্যায়ন করে একটি সমাজ গঠন করতে পারলে বাংলাদেশিরা সামাজিকমাধ্যমগুলোকে সম্পর্ক তৈরি, জাতীয় মনোভাব গড়ে তোলা এবং ইতিবাচক আর্থসামাজিক পরিবর্তনের জন্য ব্যবহার করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, নীতিনির্ধারক, সামাজিক এবং সামাজিকমাধ্যম বিশ্লেষকদের অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়