ড. জাহেদ আরমান
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ এএম
আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্লেটোর তত্ত্ব ও রাজনৈতিক কর্মীদের এনলাইটেনমেন্ট

প্লেটোর তত্ত্ব ও রাজনৈতিক কর্মীদের এনলাইটেনমেন্ট

একটি সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে ওই সমাজে বসবাসকারী মানুষের অজ্ঞতা। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার চারশো বছর আগে বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো এটাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘অ্যালেগরি অব দ্য কেভ’ দিয়ে যা তার গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’-এর সপ্তম অধ্যায়ে উল্লেখ রয়েছে। প্লেটো বলেছিলেন, মানুষের জীবন যেন একটি গুহায় শৃঙ্খলিত থাকার মতো, যেখানে পাথরের দেয়ালে ছায়াগুলোর নাচ দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাস্তব জীবনে রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ কর্মিবাহিনী তাদের নেতাদের ইশারায় ওঠে-বসে। তাদের যেভাবে নাচানো হয় সেভাবেই তারা নাচে। এর বাইরের জগৎ কিংবা ভিন্ন প্রেক্ষিত তারা চিন্তাও করতে পারে না।

‘অ্যালেগরি অব দ্য কেভ’-এ, একদল বন্দিকে জন্ম থেকে গুহায় আটকে রাখা হয়, যাদের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান নেই। এই বন্দিরা শুধু সামনেই দেখতে পায়। ডানে, বামে কিংবা পেছনে দেখার সুযোগ নেই। বন্দিদের পেছনে থাকা আগুন একটি ক্ষীণ আলো ছড়ায়। মাঝেমধ্যে কেউ আগুনের সামনে দিয়ে যায়, যারা প্রাণী বা অন্যান্য বস্তুর প্রতিমূর্তি বহন করে, যা বন্দিদের সামনের দেয়ালে ছায়া ফেলে। বন্দিরা যেহেতু শুধু সামনে দেখতে পারে তাই তারা বস্তুর প্রতিমূর্তিগুলো স্পষ্ট দেখতে পারে। বন্দিরা এ প্রতিমূর্তিগুলোকে বিভিন্ন নাম দেয়, শ্রেণিবদ্ধ করে এবং সেগুলোকে বাস্তব মনে করে।

হঠাৎ একদিন, একজন বন্দি গুহা থেকে মুক্তি পায় এবং প্রথমবারের মতো বাইরে যায়। সূর্যালোক তার চোখে লাগে এবং নতুন পরিবেশ তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। যখন তাকে বলা হয় তার চারপাশের জিনিসগুলো বাস্তব, অথচ ছায়াগুলো ছিল শুধুই প্রতিফলন, তখন সে বিশ্বাস করতে চায় না। ছায়াগুলো তার কাছে অনেক পরিষ্কার মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তার চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়। সে সত্যিটা জানতে পারে।

পরবর্তীকালে মুক্তি পাওয়া বন্দি গুহায় ফিরে এসে তার আবিষ্কার শেয়ার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তখন সে আর অন্ধকারে অভ্যস্ত হতে পারে না এবং দেয়ালে থাকা ছায়াগুলোকে ঠিকমতো দেখতে পায় না। অন্য বন্দিরা ভাবে যে তার এই যাত্রা তাকে বোকা এবং অন্ধ করে দিয়েছে এবং তারা তাকে মুক্ত করার চেষ্টা প্রতিহত করে।

প্লেটো এ রূপকটি একটি উপমা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যা একজন দার্শনিকের জনসাধারণকে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টার চিত্র। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক কর্মী তাদের অজ্ঞতায় শুধু স্বাচ্ছন্দ্য বোধই করে না, বরং যারা তা প্রকাশে তাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে।

গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, মন্ত্রী-সংসদ সদস্যসহ প্রভাবশালী ৪৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত চলছে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, “শুধু এক ব্যক্তিকে (শেখ হাসিনা) ক্ষমতায় রাখতে গণহত্যা চালাতে তারা দ্বিধা করেননি। আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যা করেছে। বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নিরস্ত্র নেতাকর্মীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিচারবহির্ভূত গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে। র্যাবকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে ভিন্নমত ও বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল।” এমনকি জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার ওপর কীভাবে বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, তা বিশ্ববাসী দেখেছে। এত কিছুর পরও কীভাবে দলটির কিছু কর্মী গণহত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে পারে! প্লেটোর ‘অ্যালেগরি অব দ্য কেভ’র মতোই তারা এখনো আওয়ামী মেটান্যারেটিভে আটকে আছে। এর বাইরেও যে সত্য আছে, ভিন্ন বাস্তবতা আছে, তা তারা দেখতে পায় না। কিংবা দেখলেও তা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক।

শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী নয়, এ ধরনের অজ্ঞতা বাংলাদেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেও আছে। দলীয় প্রধান কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিলে তারা সেটার প্রতিবাদ করে না। সেই ভুল সিদ্ধান্তের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে।

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপির অনেক কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব কর্মী পুরোনো ন্যারেটিভে আটকে ছিল। এতদিন আওয়ামী লীগ ভোগ করত, এখন তারা ভোগ করবে। এ ছিল তাদের মানসিকতা। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে তারা শিক্ষা নেয়নি। তারা এ পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু এর মাধ্যমে নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারেনি।

জামায়াতের কর্মীরা আরও এককাঠি সরেস। এদের জুজুর ভয় দেখানো হয়। এখানে নেতার আদেশ মানা বাধ্যতামূলক। আদেশ না মানলে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়। ভিন্নমত কিংবা ভিন্ন প্রেক্ষিত এদের চিন্তা করার সুযোগই নেই। আমি অনেক জামায়াত কর্মীকে দেখেছি, এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মব অ্যাটাক করে। নিজে কী মনে করে সেটা না জানিয়ে কোনো কিছু পছন্দ না হলেই গালি দিয়ে বসে। এভাবে সমাজ অগ্রসর হয় না। কোথাও হয়নি।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দলের কর্মীদের নিজের মত জানানোর পাশাপাশি ভিন্নমতও শুনতে হবে। যাই ঘটুক সমাজে, তালগাছটা আমার—এ মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশের সমাজ হবে বহু মতের, বহু দলের। ভিন্ন মতের জন্য কাউকে হেয় কিংবা বঞ্চিত করা হবে না।

রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কি অন্যায় জানার পরও নিজ দলীয় নেতাদের কর্মকাণ্ডে সমর্থন দিয়ে যাবে? নাকি সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এগিয়ে যাবে আলোর দিকে, এনলাইটেনমেন্টের দিকে। এতে আপনাদের জীবন আরামদায়ক নাও হতে পারে। কঠিন পছন্দ। তবে সান্ত্বনার কথা হলো, আপনারা একা নন। আরও অনেকে শামিল হবে আপনাদের মিছিলে। যেমনটি হয়েছিল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে। আর এভাবেই এগিয়ে যাবে সমাজ।

লেখক: অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ফ্রামিংহাম স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

হাতিয়ায় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গ্রেপ্তার

বিএনপি নেতা বদরুজ্জামান মিন্টু চিরনিদ্রায় শায়িত

ঢাকা-১৩ আসনে ধানের শীষের সমর্থনে যুবদলের গণমিছিল

নতুন জোটের ঘোষণা দিল এনসিপি

কড়াইল বস্তিতে আগুন, তারেক রহমানের সমবেদনা

কড়াইল বস্তিতে আগুনের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগ ও সমবেদনা 

গণভোট অধ্যাদেশ জারি করে গেজেট প্রকাশ

জেসিআই ঢাকা ইউনাইটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন মাসউদ

কড়াইল বস্তির আগুন নিয়ন্ত্রণে

চীনা দূতাবাস কর্মকর্তার সঙ্গে চৌদ্দগ্রাম জামায়াত নেতাদের মতবিনিময়

১০

নুরুদ্দিন আহম্মেদ অপুর সঙ্গে সেলফি তুলতে মুখিয়ে যুবসমাজ

১১

অগ্রণী ব্যাংকের লকারে শেখ হাসিনার ৮৩২ ভরি স্বর্ণ

১২

শুভর বুকে ঐশী, প্রেম নাকি সিনেমার প্রচারণা?

১৩

৭০৮ সরকারি কলেজকে চার ক্যাটাগরিতে ভাগ

১৪

ইউএস বাংলার সাময়িকীর কনটেন্ট তৈরি করবে অ্যানেক্স কমিউনিকেশনস

১৫

সাদিয়া আয়মানের সমুদ্র বিলাশ

১৬

পৌরসভার পরিত্যক্ত ভবনে মিলল নারীর মরদেহ 

১৭

কড়াইলের আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসার কারণ জানাল ফায়ার সার্ভিস

১৮

প্রশাসনের ৭ কর্মকর্তার পদোন্নতি

১৯

যুক্তরাষ্ট্রে যোগাযোগ ও মিডিয়া কনফারেন্সে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা

২০
X