শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ১ কার্তিক ১৪৩২
আবদুল রহমান আল-রাশেদ
প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৮ এএম
আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৩ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কে শাসন করবে সিরিয়া

কে শাসন করবে সিরিয়া

সিরিয়ায় ঘটে গেল অভ্যুত্থান। এখনো চলছে আনন্দ-উদযাপন। তবে বাশার আল-আসাদের সব ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার পর যখন আনন্দের রেশ কেটে যাবে, তখন এক জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সিরিয়ার নাগরিকদের। কে নেবে এখন তাদের শাসনভার? কোনো একক ব্যক্তির হাতে যাবে ক্ষমতা? নাকি কোনো গোষ্ঠীর হাতে? নাকি রাষ্ট্র ভেঙে যাবে একাধিক খণ্ডে? আসন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা মোটেই সহজ হবে না।

আসাদের শাসন-পরবর্তী সিরিয়ায় রয়েছে অনেক ক্ষমতাধর পক্ষ। আলেপ্পো শহরের ক্ষমতা দখল এবং অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে যেই দল, সেটি হলো হায়াত তাহরির আল-শামের। এই দলের প্রধান নেতা মোহাম্মেদ আল-গোলানি। দলটির উত্থান ঘটে সিরিয়ার পশ্চিম সীমান্তে; তুরস্ক প্রভাবিত অঞ্চল থেকে। আর দামেস্কে প্রবেশ করে যেই দল, সেটি হলো সাউদার্ন অপারেশনস রুম। তাদের মূল ঘাঁটি দেরা রাজ্যে। আর এই দলের মুখপাত্র আহমাদ আল-উদা। এই দলের সদস্যরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের দল গঠন করে। অন্যদিকে ইরাকের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চলে ক্ষমতার দখল নেয় সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস। এই দল কুর্দিশ সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিকালে জার্মানির রাজধানী বার্লিন শহরের যে দৃশ্য ছিল, বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দৃশ্য ঠিক তেমনই। বার্লিন নগরের পশ্চিম দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে ব্রিটেন ও আমেরিকার মিত্রবাহিনী। আর পূর্বদিক থেকে প্রবেশ করে সোভিয়েত বাহিনী। হিটলারের পতন বিষয়ে তারা সম্মত হলেও জার্মানির শাসন বিষয়ে তাদের ছিল মতভিন্নতা। অতঃপর পূর্ব বার্লিনের শাসনভার সোভিয়েতরা নেয়। আর শহরের পশ্চিম অংশের দায়িত্ব নেয় পশ্চিমারা। দামেস্কে বিজয় উল্লাসের দিনও দেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীতে প্রবেশ করে ভিন্ন ভিন্ন দলের বিদ্রোহীরা। বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আবশ্যক—এ বিষয়ে অন্তত তাদের সহমত ছিল বিধায় এ শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজল্যুশন ২২৫৪-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দল, ব্যক্তিবর্গ এবং বিপ্লবীদের সমন্বয়ে নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করা হবে—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্যই রেজল্যুশনটি সমর্থন দিয়েছে। এখানে যেই তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, নতুন সংবিধান রচনা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। হায়াত তাহরির আল-শাম গোষ্ঠীটিই সিরিয়ার শাসনভারের বৃহৎ অংশের দায়িত্ব নেবে বলে মনে হচ্ছে। কার্যত মাত্র দুই সপ্তাহের ভেতর বাশার আল-আসাদের সরকারের পতন ঘটাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তারাই পালন করেছে। একই সঙ্গে সিরিয়ার বিপ্লবী দলগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রভাবশালী। অন্যদিকে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস দেশের পূর্বাঞ্চচলের শাসনভার নেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির মতো সিরিয়ার শাসনও দুটো অংশে ভাগ হয়ে যেতে পারে। আর বার্লিন ওয়ালের মতো সিরিয়ার দুই অংশের মধ্যে সীমানা হয়ে দাঁড়াতে পারে ইউফ্রেটিস নদী, যা দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ইরাক হতে সিরিয়ায় প্রবেশ করে উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে তুরস্কে চলে গেছে। তবে বিপ্লবী দলগুলো যদি ক্ষমতা ভাগ করে নিতে সম্মত হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দেশের সরকার গঠন করা যেতে পারে। হায়াত তাহরির আল-শামের নেতা আল-গোলানি এমনটাই প্রস্তাব করেছিলেন।

এ কথা সত্য যে, সিরিয়া শুধু সিরিয়ানদের নয়। ইতিহাসব্যাপী বারবার সিরিয়ার অধিবাসীদের এই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ক্ষমতাধর শক্তিগুলো বিভিন্ন সময়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আসছে। ইতিহাসবেত্তা জেমস বার তার ‘এ লাইন ইন দ্য স্যান্ড’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন কীভাবে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্রিটিশ এবং ফরাসিরা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এ অঞ্চলের শাসনভার নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আদিকাল থেকেই ইরান, তুরস্ক, ইরাক এবং ইসরায়েল সিরিয়ায় নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে আসছে। ভবিষ্যতেও তারা তাদের প্রভাব বলবৎ রাখার প্রয়াস চালাবে। এই দেশগুলোর সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক কীরূপ হবে—তা নির্ভর করছে তাদের চাহিদা এবং আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতির ওপর। যেই দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়ার উত্থানকে আশঙ্কা হিসেবে মনে করবে, তাদের সঙ্গে সিরিয়ার বৈরী সম্পর্ক গড়ে উঠবে। আর যারা এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন সরকারকে সমর্থন দেবে, তাদের সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি হবে। সিরিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা গেলে যেই দেশগুলো লাভবান হবে, তার মধ্যে ইরান অন্যতম।

দামেস্কের সামনে এখন পথ দুটো। হয় তাকে অপেক্ষা করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য নিয়ে সামনে এগোতে হবে। অথবা তাকে জলদি পদক্ষেপ নিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, আসাদ সরকার পতনের পর আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ইরাক, ইরান এবং ইসরায়েল সবাই শঙ্কিত। সিরিয়ার নিজস্ব স্বার্থ আদায় করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকার এবং নাগরিকদের মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে, তা দূর করতে হবে। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বাশার আল-আসাদের শাসনামলে নিজ দেশের নাগরিকদের ভেতর যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, তা কমিয়ে আনতে হবে। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক পুনর্গঠনের নীতি তাই নতুন সরকারের জন্য বেশ ফলপ্রসূ হবে। গত সপ্তাহে আল-গোলানি ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে টেলিভিশনের মাধ্যমে যে বার্তা প্রেরণ করেছেন, সেখানে তিনি এমন মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, নতুন সিরিয়া বাগদাদের প্রতিপক্ষ নয়, বরং মিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পাশাপাশি ইরাকিদের সঙ্গে সম্মানের সম্পর্ক গড়ে তুলবে।

দীর্ঘ পাঁচ দশক পুরোনো এক শাসনের থেকে মুক্তি পেয়েছে সিরিয়া। তাকে এখন মোকাবিলা করতে হবে বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ। নতুন করে রাষ্ট্র গঠন করতে হলে প্রয়োজন অর্থ, সমর্থন ও ধৈর্য। আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাহায্য প্রয়োজন সিরিয়ার। শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক সহায়তাও প্রয়োজন। স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের হাতে যেন ক্ষমতা না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। নতুন নেতৃত্ব যেন জনগণের কল্যাণমুখী হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৩ বছর ধরে অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে সিরিয়া। দেশের ভবিষ্যৎ এখন বিপ্লবীদের হাতে। সফল হতে হলে তাদের আগে জানতে হবে, বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন আনতে গিয়ে কোন বিপ্লবীরা ব্যর্থ হয়েছে, কেন হয়েছে এবং কীভাবে হয়েছে।

লেখক: সৌদি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী। আশারক আল-আরাবিয়া পত্রিকার সাবেক সম্পাদক এবং আল-আরাবিয়া নিউজ চ্যানেলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে ভাষান্তর করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সম্মতি ছাড়াই ঢাবির দুই অধ্যাপককে কমিটিতে রাখল ইউটিএল

ঢাকায় ১০ কোটি টাকার বাজেটে নারী কাবাডি বিশ্বকাপ

রাকসু নির্বাচন / খালেদা জিয়া হলের ফল ঘোষণা

রাকসুতে ৩ হলের ফল ঘোষণা, এগিয়ে যারা

সেমিফাইনালে থামলেন জারিফ

বরিশালে কালবেলার বর্ষপূর্তি উদযাপন / ‘আগামী দিনেও জনগণের কথা বলবে কালবেলা’

রাকসুতে রোকেয়া হলের ফল ঘোষণা

পুরো ভবনটিই জ্বলছে, থেমে থেমে বিস্ফোরণ

রাকসুর এক হলের ফল ঘোষণা, ভিপি-এজিএসে এগিয়ে শিবির

তিন পেরিয়ে চারে কালবেলা / সত্য-সুন্দর-সাহসের অভিযাত্রায় নতুন স্বপ্ন

১০

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা 

১১

কুষ্টিয়ায় কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

১২

চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে বক্তারা / পরিশুদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবে কালবেলা

১৩

ফরিদপুর বিভাগ বাস্তবায়ন দাবিতে পদযাত্রা ও গণসমাবেশ

১৪

সিলেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সুধীজনদের মিলনমেলা / ‘কম সময়ে কালবেলা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি অবদান রাখছে’

১৫

বিএনপিতে যোগ দিলেন চার শতাধিক সনাতনী ধর্মাবলম্বী

১৬

ইবিতে পুকুরে ডুবে যাচ্ছিলেন দুই শিক্ষার্থী, বাঁচালেন সিনিয়র

১৭

কালবেলার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শরীয়তপুর সাংবাদিক সমিতির শুভেচ্ছা

১৮

দীপাবলির আগে ভারতে স্বর্ণ চোরাচালানের হিড়িক, রেকর্ড দাম কালোবাজারে

১৯

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে লালন স্মরণোৎসব শুরু শুক্রবার

২০
X