গতকাল মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানায় গোটা জাতি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সোমবার জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষণে ড. ইউনূস পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ের নায়ক মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখ লাখ শহীদ, শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ জনতার আত্মত্যাগকে স্মরণ করেন গভীর শ্রদ্ধায়। স্মরণ করেন সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদেরও। এ ছাড়া তিনি নির্বাচন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, শ্বেতপত্র কমিটি, ঐক্য কমিশন গঠন, সংস্কার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। বিজয়ের মাসে তিনি বাংলাদেশের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিজয়ের মাস হোক নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ রাজনৈতিক পরিচয়নির্বিশেষে জাতির মহাঐক্যের মাস।
জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম পর্যায়ে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এই ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠনের দিকে সরকার এগোচ্ছে। তিনি নিজেই এ কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান। এ সময় আগামী জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে বলেন, আমি সব প্রধান সংস্কার সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। জাতীয় ঐক্য কমিশনের কাজের ব্যাখ্যা দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা ও বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা। তিনি বলেন, যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তী সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, তা বিবেচনা করে আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করব।
আমরা জানি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একটি বিশেষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে দেশ। নাজুক অর্থনীতি, পুলিশ বাহিনীর দুর্বল অবস্থা, নিত্যপণ্যের বাজারে অতিউত্তাপসহ নানামুখী সংকট বিরাজ করছে। বিশেষ করে সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চলছে সম্পর্কের এক ধরনের টানাপোড়েন। দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে বর্তমান সরকার জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। দেশের রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা এতে সাড়া দেন। দেশের কল্যাণের প্রশ্নে তারা সবাই ঐকমত্যে পৌঁছান। প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণেও জাতীয় ঐক্যের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পায়। মহান বিজয়ের মাসে তাই দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান ধ্বনিত হয় তার কণ্ঠে। আমরা মনে করি, একাত্তরের মহান বিজয় দেশের সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সব মানুষের কল্যাণের স্বার্থে পুরো জাতির মধ্যে এই মহাঐক্য গড়ে তোলার অনিঃশেষ প্রেরণার জায়গা; যার সফল প্রতিফলন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান। আমাদের বিশ্বাস, একাত্তর ও জুলাইয়ের চেতনা জাতির সেই অভীষ্ট মহাঐক্যে পৌঁছে দেবে।